কাগজের মুদ্রার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

টাকা বা আরো বিশেষ করে বললে, অর্থ আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। কিন্তু টাকা শুধু ধাতব মুদ্রা বা কাগজের নোট নয়, এটি একটি ব্যবস্থা, যা সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে সচল রাখে। ইসলামি ও পশ্চিমা রাষ্ট্রে মুদ্রার ভূমিকা কীভাবে গড়ে উঠেছে এবং এর কাজ কী ছিল, তা বোঝার জন্য আমাদের ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখতে হবে।

ইসলামি রাষ্ট্রে মুদ্রার ভূমিকা

অতীতে মানুষ বিনিময় প্রথার (Barter System) মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। কিন্তু এ প্রথায় অনেক সমস্যা ছিল। ধরুন, কেউ গম বিক্রি করতে চায়, কিন্তু তার বিনিময়ে তিনি ছাগল চান। যদি ছাগলের মালিক গম না চায়, তাহলে লেনদেন সম্ভব হতো না। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে। তখনই টাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, যা একটি সাধারণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং বিনিময়প্রক্রিয়াকে সহজ করে।

উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) উটের চামড়া দিয়ে মুদ্রা তৈরির কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁকে বলা হয়, এতে মানুষ উট জবাই করবে চামড়ার জন্য, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে।

ইসলামি ইতিহাসে মুদ্রার ব্যবহার ও এর ভূমিকা নিয়ে ফকিহরা গভীর আলোচনা করেছেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বালাজুরি তাঁর ফুতুহুল বুলদান গ্রন্থে উল্লেখ করেন, জাহেলিয়াত যুগে মক্কায় হেরাক্লিয়াসের দিনার (সোনার মুদ্রা) এবং পারস্যের রুপার দিরহাম ব্যবহৃত হতো। এই মুদ্রাগুলো সোনা বা রুপার ওজন হিসেবে গৃহীত হতো।

নবীজি (সা.) এ ব্যবস্থাকে বহাল রাখেন এবং খলিফা আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (রা.)-এর সময়েও এটি অব্যাহত থাকে। পরবর্তী সময়ে মুয়াবিয়া (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়রের শাসনামলে নতুন দিরহাম ও দিনার প্রচলিত হয়। খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান দামেস্কে নতুন দিনার প্রবর্তন করেন, যা ইসলামি মুদ্রার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। (বালাজুরি, ফুতুহুল বুলদান, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত: ১৯৮৮, পৃ. ২৬৫)

উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) উটের চামড়া দিয়ে মুদ্রা তৈরির কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁকে বলা হয়, এতে মানুষ উট জবাই করবে চামড়ার জন্য, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। ফলে তিনি এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন।

এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ইসলামি ফকিহরা মুদ্রার উপাদান নিয়ে নমনীয় ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, মুদ্রার উপাদান যা-ই হোক না কেন, এটি শুধু একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।

আরও পড়ুন
মুদ্রার কোনো নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বা শরিয়ত-নির্ধারিত সীমা নেই। এটি সমাজের প্রথা ও চুক্তির ওপর নির্ভর করে। মুদ্রার উদ্দেশ্য হলো লেনদেনের মাধ্যম হওয়া এবং মূল্যের মাপকাঠি হিসেবে কাজ করা।
ইবনে তাইমিয়া (রহ.), মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া

ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট মত দেন। তিনি বলেন, মুদ্রার কোনো নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বা শরিয়ত-নির্ধারিত সীমা নেই। এটি সমাজের প্রথা ও চুক্তির ওপর নির্ভর করে। মুদ্রার উদ্দেশ্য হলো লেনদেনের মাধ্যম হওয়া এবং মূল্যের মাপকাঠি হিসেবে কাজ করা। এটি নিজে কোনো সম্পদ নয়, বরং অন্য সম্পদের সঙ্গে লেনদেনের একটি সরঞ্জাম। (মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া, ২৯/২৫১, দারুল ওয়াফা: ২০০১)

মুদ্রার কার্যকারিতা

ইসলামি দৃষ্টিকোণে মুদ্রার ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন দামেস্কের পণ্ডিত আল-দিমাশকি। তিনি বলেন, ‘মানুষ সোনা ও রুপাকে সবকিছুর মূল্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এটি চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে, যাতে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস যখন ইচ্ছা কিনতে পারে। যার কাছে সোনা বা রুপা আছে, তার কাছে যেন সব ধরনের পণ্য হাতের নাগালে থাকে।’ (আল-ইশারাহ ইলা মাহাসিনিত তিজারাহ, পৃ. ৪৭)

এই বক্তব্য থেকে টাকার তিনটি প্রধান কার্যকারিতা স্পষ্ট হয়—

১. মূল্যের মাপকাঠি: মুদ্রা দিয়ে পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণ করা যায়।

২. বিনিময়ের মাধ্যম: মুদ্রা দিয়ে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে।

৩. মূল্য সঞ্চয়ের মাধ্যম: মুদ্রা দিয়ে সম্পদ সংরক্ষণ করা যায়।

এই কার্যকারিতাগুলো আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। পশ্চিমা রাষ্ট্রেও টাকার এই কার্যকারিতাগুলো একই রকম। তবে ইসলামি দৃষ্টিকোণে মুদ্রার উপাদান নিয়ে নমনীয়তা বেশি ছিল।

ফকিহগণ মনে করতেন, মুদ্রা শুধু সোনা বা রুপা হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেকোনো উপাদান মুদ্রা হিসেবে গ্রহণযোগ্য, যদি তা সমাজের চুক্তি ও শাসকের অনুমোদন পায়।

আরও পড়ুন

ইসলামি ও পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ

পশ্চিমা দৃষ্টিকোণে মুদ্রার মূল্য প্রায়ই এর ধাতব উপাদানের ওপর নির্ভর করত। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, মুদ্রার নিজস্ব মূল্য থাকতে হবে। কিন্তু ইসলামি ফকিহগণ, যেমন ইবনে তাইমিয়া, এ বিষয়ে আরও বাস্তববাদী ছিলেন। তাঁরা বলেন, মুদ্রার মূল্য এর উপাদানের ওপর নির্ভর করে না, বরং এটি সমাজের চুক্তি ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। উমর (রা.)-এর উটের চামড়ার মুদ্রার ধারণা এই নমনীয়তার প্রমাণ।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো মুদ্রার অর্থনৈতিক প্রভাব। উমর (রা.) বুঝতে পেরেছিলেন, উটের চামড়া মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করলে উটের সংখ্যা কমে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এই দূরদর্শিতা ইসলামি অর্থনীতির স্থিতিশীলতার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, মুদ্রার নিজস্ব মূল্য থাকতে হবে। কিন্তু ইসলামি ফকিহগণ, যেমন ইবনে তাইমিয়া, এ বিষয়ে আরও বাস্তববাদী ছিলেন।

মুদ্রার আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

আজকের দিনে মুদ্রা আর শুধু ধাতব মুদ্রা নয়। কাগজের নোট, ডিজিটাল মুদ্রা ও ক্রিপ্টোকারেন্সি টাকার নতুন রূপ। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এই নতুন রূপগুলো গ্রহণযোগ্য, যদি তা সমাজের চুক্তি ও শরিয়তের নীতি মেনে চলে। ইসলামি অর্থনীতিতে টাকার মূল উদ্দেশ্য হলো লেনদেনকে সহজ করা এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

সারকথা

ইসলামি ও পশ্চিমা রাষ্ট্রে টাকার ভূমিকা অনেকাংশে একই রকম হলেও ইসলামি দৃষ্টিকোণে এর নমনীয়তা ও নৈতিক দিকটি বেশি গুরুত্ব পায়। মুদ্রা বা টাকা কেবল একটি বিনিময়ের মাধ্যম নয়, এটি সমাজের অর্থনৈতিক ও নৈতিক ভারসাম্য রক্ষার একটি হাতিয়ার।

নবীজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মুদ্রার কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা সমাজের চাহিদা ও পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। ইসলামি ফকিহদের দূরদর্শিতা আমাদের শেখায়, মুদ্রার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের জীবনকে সহজ করা এবং সমাজে ন্যায় ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

সূত্র: ইসলাম অনলাইন ডটনেট

আরও পড়ুন