ইসলামের মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিদান বা প্রতিফলের নীতি। এই নীতিই মানুষকে সৎকর্মের প্রতি সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করে। কিন্তু অনেক সময় বাস্তবতার নিরীখে দেখা যায়, যারা বিশাল ত্যাগ ও প্রচেষ্টা করেছেন, তারা পৃথিবীতে তার কোনো দৃশ্যমান ফল বা প্রতিদান পাননি।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই পর্যবেক্ষণ কি সঠিক, নাকি এটি কেবলই একটি অদূরদর্শী ধারণা?
এই প্রবন্ধে আমরা সাহাবিদের জীবনের দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—মুসআব ইবনে উমাইর (রা.) এবং আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর জীবন তুলনার মাধ্যমে সৎকর্মের প্রতিদান তাৎক্ষণিক হবে নাকি আখেরাতে বিলম্বিত হবে, সেই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অনুসন্ধান করব।
এই দুজনের মধ্যে একজন সম্পর্কে সাহাবি খাব্বাব (রা.) বলেছিলেন, “তার প্রতিদান আল্লাহর হাতে ন্যস্ত হয়েছে,” আর অন্যজন সম্পর্কে বলেছিলেন, “তার ফসল পেকেছে, আর সে তা কেটে নিচ্ছে।”
এই কাজের ফলে দুনিয়াতে কী ফল আসবে বা তা উপভোগ করা যাবে কি না, সেই চিন্তা ছিল তাঁদের কাছে নিতান্তই গৌণ।
একটি অনন্য প্রজন্ম তৈরির ভিত্তি
এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করার আগে আমাদের সেই মহান মূল্যবোধগুলো স্মরণ করা উচিত, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। এই মূল্যবোধগুলো বুঝতে পারলেই আমরা উপলব্ধি করতে পারব, কেন তারা নিজেদের সবটুকু বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হলো—আল্লাহর হেদায়েতের নুরকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই মহৎ দায়িত্ব পালনের সময় তাঁরা কেবল একটি চিন্তাই করতেন, আল্লাহর নুর যেন সৃষ্টিকুলের কাছে পৌঁছাতে পারে, তার জন্য তাঁরা কী করতে পারেন?
এর বিপরীতে, এই কাজের ফলে দুনিয়াতে কী ফল আসবে বা তা উপভোগ করা যাবে কি না, সেই চিন্তা ছিল তাঁদের কাছে নিতান্তই গৌণ।
এই কারণেই ইসলামের প্রথম দিকে আমরা এমন অনেক মানুষকে দেখতে পাই, যারা আল্লাহর প্রতি গভীর ইমান এনেছেন এবং পার্থিব কোনো ফল লাভের আশা না করে নিজেদের সবকিছু এই বিশ্বাসের পথে উৎসর্গ করেছেন।
আবার তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিপুল ত্যাগ করেছেন এবং আল্লাহ তাঁদের প্রতিদানস্বরূপ দুনিয়াতেও প্রচুর কল্যাণ দান করেছেন, পাশাপাশি আখেরাতের বিশাল প্রতিদানের ওয়াদা তো আছেই, যা সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম।
আব্দুর রহমান ইবনে আউফের কথা
যারা দুনিয়াতে কল্যাণ লাভ করেছেন এবং যারা পাননি, উভয় দলের অন্তর্ভুক্ত সাহাবিদের প্রতি ইঙ্গিত করে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর একটি ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইমাম বুখারি (রহ.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন:
একদা আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর সামনে খাবার আনা হলো, আর তিনি ছিলেন রোজাদার। তিনি তখন বললেন, “মুসআব ইবনে উমাইর (রা.) শহীদ হয়েছেন, অথচ তিনি আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। তাঁকে একটি চাদরে কাফন দেওয়া হয়েছিল, যা দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত, আর পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যেত।”
বর্ণনাকারী বলেন, সম্ভবত তিনি আরও বলেছিলে, “এবং হামজা (রা.) শহীদ হয়েছেন, অথচ তিনিও আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। এরপর আমাদেরকে দুনিয়ার এত প্রাচুর্য দান করা হয়েছে—বা বললেন, এত কিছু দেওয়া হয়েছে—যে আমরা আশঙ্কা করছি, না জানি আমাদের ভালো কাজের প্রতিদান এখানেই (মানে দুনিয়াতেই) দ্রুত দিয়ে দেওয়া হয়।”
এরপর তিনি কাঁদতে শুরু করলেন এবং খাবার ছেড়ে দিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৭৫)
জীবনের এক আরামদায়ক মুহূর্তে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তাঁর সেই ভাইদের স্মরণ করলেন, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি স্মরণ করলেন তাঁদের ত্যাগ ও সংগ্রাম, এবং কীভাবে মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-এর মতো মহান ব্যক্তিও দুনিয়া থেকে এমন চরম দারিদ্র্যের অবস্থায় বিদায় নিলেন যে তাঁর জন্য কাফনের কাপড়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, তিনি নিজের জীবনের প্রাচুর্য ও আরাম-আয়েশের দিকে তাকালেন এবং দুনিয়ার প্রতি তাঁর যে ভয় ছিল, তা তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করলো যে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং খাবার খাওয়া ছেড়ে দিলেন।
মুসআব ইবনে উমাইরের কথা
সাহাবি ও নেককারদের জীবনচরিত অনুসন্ধান করলে আমরা মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-এর অনন্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, যিনি প্রাচুর্যের জীবন থেকে কঠিন, দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করে এক বিশাল ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
প্রশ্ন হলো, এই বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে তিনি কি দুনিয়াতে কোনো প্রতিদান লাভ করেছিলেন? অবশ্যই করেছিলেন। যত ঘরে ইসলামের নূর প্রবেশ করেছিল, মুসআব (রা.)-এর হৃদয়ে ততটাই নূর ও আনন্দ প্রবেশ করেছিল।
এই আনন্দ ও আত্মিক তৃপ্তি এমন একটি নেয়ামত, যা কোনো ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি বা কোনো পার্থিব বস্তু দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না। দুনিয়াতে অনেক সচ্ছল মানুষ আছে, যারা জাগতিক সুখের উপকরণ থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের প্রকৃত সুখ বা আনন্দের ছিটেফোঁটাও অনুভব করে না।
সাহাবিগণ সব সময় দীর্ঘ হিসাব-নিকাশ এবং আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয়ে ভীত থাকতেন। তাঁরা নিজেদেরকে অতি নগণ্য মনে করতেন এবং জান্নাত নিশ্চিত হয়েও উচ্চতর মর্যাদা লাভ করতে চাইতেন।
মুসআব ইবনে উমাইর (রা.) আখেরাতে তাঁর জন্য প্রস্তুত করে রাখা সেই প্রতিদান—যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং মানুষের হৃদয়ে যার কল্পনাও উদয় হয়নি—দেখার আগেই দুনিয়াতে তাঁর প্রচেষ্টার কিছু ফল ভোগ করেছিলেন, আর তা হলো মানসিক ও আত্মিক শান্তি।
সৎকর্মশীলদের জীবন থেকে শিক্ষা
আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর হাদিস থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই:
আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তির উচিত, মানুষকে সৎকর্মশীলদের জীবনচরিত স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং দুনিয়ার প্রতি তাঁদের আগ্রহের অভাব সম্পর্কে বলা, যাতে মানুষের মনেও দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ কমে যায়।
নেককারদের থেকে পিছিয়ে পড়ার ভয় এবং তার জন্য কান্নাকাটি করা উচিত, যেমন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) কেঁদেছিলেন এবং খাবার ছেড়েছিলেন।
মানুষের উচিত সর্বদা আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত স্মরণ করা, তার কৃতজ্ঞতা আদায়ে নিজের দুর্বলতা স্বীকার করা এবং এই নেয়ামতের হিসাব আখেরাতে দিতে হবে—এই ভয় করা।
যদি কেউ প্রশ্ন করে, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তো জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছিলেন, তাহলে কেন তিনি কাঁদলেন?
উত্তর হলো, সাহাবিগণ সব সময় দীর্ঘ হিসাব-নিকাশ এবং আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয়ে ভীত থাকতেন। তাঁরা নিজেদেরকে অতি নগণ্য মনে করতেন এবং জান্নাত নিশ্চিত হয়েও উচ্চতর মর্যাদা লাভ করতে চাইতেন।
এ কারণেই তাঁরা উচ্চ মর্যাদা থেকে পিছিয়ে পড়ার ভয়ে এবং দীর্ঘ হিসাব-নিকাশের আশঙ্কায় কাঁদতেন। (আল-আসকালানী, ফাতহুল বারি, ৩/ ২০৫, দার আল-মা'রিফা, বৈরুত, ১৩৭৯ হিজরি)