আল্লাহর ওলি হতে চাইলে কী করতে হবে

ইসলামে কিছু মর্যাদার সুনির্দিষ্ট শর্ত আছে। সাহাবি হতে হলে রাসুল (সা.)-এর সাক্ষাৎ প্রয়োজন। শহীদ হতে হলে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মৃত্যু প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহর অলি হওয়ার কোনো স্পষ্ট সীমারেখা নেই।

তাঁদের বৈশিষ্ট্য হলো ইমান ও তাকওয়া, যা প্রতিটি মুসলিমের থাকা উচিত। এই গুণগুলো যেভাবে তাঁরা প্রকাশ করেন, তা-ই তাঁদের সুউচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যায়। তাঁরা অন্য কোনো কারণে নয়, বরং আল্লাহর প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও আনুগত্যের কারণেই সম্মানিত।

আল্লাহর ওলি কে

‘ওলি’ শব্দের অর্থ বন্ধু বা অভিভাবক। ইসলামি আদর্শের বড় বৈশিষ্ট্য হলো রবের প্রতি নিষ্ঠা। যাঁরা এই গুণে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তাঁদের ‘আল্লাহর ওলি’ বা ‘আল্লাহর বন্ধু’ বলা হয়। ওলি শব্দটির বিশদ আরেকটি অর্থ হলো ‘যিনি আল্লাহর নিকটবর্তী’। এই দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর নৈকট্যই আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য।

নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলিদের জন্য কোনো ভয় থাকবে না, তারা দুঃখও করবে না। তারা যারা ইমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করে।
সুরা ইউনুস, আয়াত: ৬২-৬৩

নিশ্চয় এই প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে যে এই মর্যাদা কীভাবে অর্জন করা যায়? একুশ শতকেও কি আমরা এমন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারব? উত্তরটি কোরআনে রয়েছে। সুরা ইউনুসে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর ওলিদের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলিদের জন্য কোনো ভয় থাকবে না, তারা দুঃখও করবে না। তারা যারা ইমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করে।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৬২-৬৩)

আরও পড়ুন

বোঝা গেল, যাঁদের স্রষ্টার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক, তাঁদের বৈশিষ্ট্য হলো উমান ও তাকওয়া (আল্লাহভীতি)। তাঁদের বুকে ইসলামের শিখা একটি জ্বলন্ত এবং জাহান্নামের ভয় সদা জাগ্রত। আর তাঁদের দায়িত্ব—ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধ। হ্যাঁ, অনেক মুসলিমের মধ্যেই এই গুণগুলো থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহর ওলিদের বিশিষ্ট করে দেয় এই গুণগুলোর প্রকাশের মাত্রা।

শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (রহ.) আল-ফুরকান বাইনা আউলিয়া আর-রাহমান ওয়া আউলিয়া আশ-শাইতান গ্রন্থে বলেন, ‘আল্লাহওয়ালা’ হলো আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসার মাধ্যমে অর্জিত একটি মর্যাদার নাম। ওলি হলেন আল্লাহর আনুগত্য ও ভালোবাসায় এমনভাবে পূর্ণ ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ যা ভালোবাসেন, তা ভালোবাসেন এবং তিনি যা ঘৃণা করেন, তা-ই ঘৃণা করেন আর আল্লাহর বন্ধুদের বন্ধু এবং শত্রুদের শত্রু হিসেবে গ্রহণ করেন।

একটি কাজ ‘ভালো’ তখনই হয়, যখন তাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন; একটি কাজ ‘খারাপ’ তখনই বলব, যখন তা তাঁর অসন্তুষ্টি ডেকে আনে।

তাঁরা সর্বদা ভালো কাজের চেষ্টায় ব্যাকুল থাকেন, কখনো নেক আমলের সুযোগ হাতছাড়া করেন না। কেবল গুনাহ থেকে বিরত থাকেন না, বরং অনৈতিক কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু থেকে দূরে থাকেন।

পবিত্র কোরআন বলছে, ‘তারা আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে, ভালো কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজে নিষেধ করে এবং সৎ কাজে দ্রুত এগিয়ে যায়।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত: ১১৪)

আরও পড়ুন

ইমান বাড়ানোর কৌশল

ইমানের শুরু নিয়ত থেকে। আমরা কেন ভালো কাজ করি? কেন আমরা আমাদের অর্থ, সময় এবং শক্তি সৎ কাজে উৎসর্গ করি? এর উত্তর আমাদের ফিতরাতে, সৃষ্টিজাত স্বভাবে; যার উৎস আল্লাহ। একটি কাজ ‘ভালো’ তখনই হয়, যখন তাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন; একটি কাজ ‘খারাপ’ তখনই বলব, যখন তা তাঁর অসন্তুষ্টি ডেকে আনে। আল্লাহর ওলির জন্য এই সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির অনুভূতিই মৌলিক প্রেরণা হয়ে থাকে।

আমাদের পিতা-মাতার সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভাবুন। আমরা কেন তাঁদের সেবা করি? সামাজিক বাধ্যবাধকতা বা স্বার্থের জন্য নয়, বরং ভালোবাসার জন্য। তাদের আনন্দ আমাদের আনন্দ দেয়। এভাবে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের সঙ্গে মেলান, যিনি আমাদের ভালোবাসেন মায়ের চেয়ে ৯৯ গুণ বেশি, যিনি আমাদের শিরা থেকেও নিকটতর। তাঁর সন্তুষ্টি কি আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়?

যে ব্যক্তি রাসুলকে অনুসরণ করেন, আল্লাহ তাঁকে ভালোবাসেন। যে দাবি করেন আল্লাহ তাঁকে ভালোবাসেন, কিন্তু যে রাসুলকে অনুসরণ করেন না, তিনি আল্লাহর ওলি নন।
ইবনে তাইমিয়া (রহ.)

কীভাবে আল্লাহর ওলি হব

আল্লাহর সন্তুষ্টির চারপাশে জীবনকে কেন্দ্রীভূত করা ওলি হওয়ার মূল পদক্ষেপ। এর জন্য দরকার তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের স্পষ্ট বোঝাপড়া। আল্লাহ কোনো দূরবর্তী, উদাসীন সত্তা নন; তিনি বান্দাদের ভালোবাসেন, যত্ন নেন এবং আমাদের রিজিক দেন। সুতরাং তাঁর সমীপে উপস্থিত হওয়ার সময় পিতা-মাতার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা; বিশ্বস্ত বন্ধুর চেয়েও বেশি ভরসা এবং সন্তানের চেয়েও বেশি আকুলতা নিয়ে যেতে হবে।

আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যবহারিক কৌশল হলো, তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের মনোযোগে উন্নতি ঘটানো। প্রার্থনা, জিকির বা তিলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে হবে। ফরজ নামাজের বাইরে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করতে হবে, যখন আমরা নির্জনে তাঁর ধ্যানে মগ্ন হব। অনেক আলেম রাতে এই অভ্যাস গড়ে তুলতেন। আমরা সব দুর্বলতা নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হব।

পাপের তওবা, অপ্রত্যাশিত নিয়ামতে কৃতজ্ঞতা, দৃঢ় সংকল্পের জন্য প্রার্থনা এবং জীবনের পরিকল্পনা তখন তাঁর সঙ্গে শেয়ার করব। নিয়মিত এই আমল তাঁর নৈকট্যের দিকে নিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া আল্লাহর নাম, সেগুলোর অর্থ জানা এবং ধারাবাহিক আমলের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসাও তাঁর সন্তুষ্টির অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, ‘বলো, [হে মুহাম্মদ], তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত: ৩১)

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘এই আয়াতে আল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন, যে ব্যক্তি রাসুলকে অনুসরণ করেন, আল্লাহ তাঁকে ভালোবাসেন। যে দাবি করেন আল্লাহ তাঁকে ভালোবাসেন, কিন্তু যে রাসুলকে অনুসরণ করেন না, তিনি আল্লাহর ওলি নন।’ সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করা এবং সকাল-বিকেল দরুদ পাঠ করা রাসুলের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

বাইরে পা রাখলে অশালীন দৃশ্য, কুৎসিত কথা এবং হারাম সংগীতের মুখোমুখি হই। তাই দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে। আল্লাহর ওলি মানে পাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন, বরং তাঁরা পাপের মুখোমুখি হলে চিনতে পারেন এবং তা থেকে দূরে সরে যান।

ফরজ ইবাদতকে অগ্রাধিকার দিন। তাহাজ্জুদে রাত কাটানোর আগে ফজর নিশ্চিত করুন। ফরজ ইবাদত স্থিতিশীল হলে, নফল কাজ যেমন সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা, তাহাজ্জুদ এবং দান ইমান বাড়ায়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি কাজ তার জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য এবং আমি এর জন্য পুরস্কার দেব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৮৯৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,১৫১)

ওলিদের তাহাজ্জুদের আমল সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা রাতের কিছু অংশ তাদের রবের কাছে সিজদা ও দাঁড়িয়ে কাটায়।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৬৪)

আরও পড়ুন

তাকওয়া বাড়ানোর উপায়

ইমান হলো কথা, কাজ ও আচরণে সচেতনতা, আর তাকওয়া হলো আমাদের চারপাশে যা আছে এবং যা কিছু আমাদের ভেতর জাগে সবকিছুর প্রতি সচেতনতা। খাবার হতে হবে হালাল, সম্পদ হতে হবে বৈধ উৎস থেকে, পোশাক হতে হবে শালীন। যা দেখব এবং শুনব সব হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

আমাদের তাকওয়ার ওপর আক্রমণ চলতেই থাকে। বাইরে পা রাখলে অশালীন দৃশ্য, কুৎসিত কথা এবং হারাম সংগীতের মুখোমুখি হই। তাই দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর ওলি মানে পাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন, বরং তাঁরা পাপের মুখোমুখি হলে চিনতে পারেন এবং তা থেকে দূরে সরে যান।

পাপ কখনো আল্লাহর জন্য করা যায় না, কিন্তু জায়েজ কাজ নিয়তের ভিত্তিতে আল্লাহর জন্য করা যায়। আল্লাহর ওলিদের বৈশিষ্ট্য হলো তাঁদের প্রতিটি কাজ, যতই সাধারণ হোক, আল্লাহর নামে করা।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) মাজমু’আয়ে ফাতাওয়াতে বলেন, ‘ইমানদারের জন্য তওবা অপরিহার্য। কেউ আল্লাহর নিখুঁত নৈকট্য অর্জন করতে পারে না বা তিনি যা অপছন্দ করেন, তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে না, তওবা ছাড়া।’

তাকওয়ার একটি বড় অংশ হলো পাপের স্বীকৃতি ও তওবা। এই স্বীকৃতির জন্য ইলম প্রয়োজন। কোনো কিছু পাপ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ হলে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সহজ প্রশ্ন হলো, ‘এটি কি আল্লাহর জন্য করা যায়?’

পাপ কখনো আল্লাহর জন্য করা যায় না, কিন্তু জায়েজ কাজ নিয়তের ভিত্তিতে আল্লাহর জন্য করা যায়। আল্লাহর ওলিদের বৈশিষ্ট্য হলো তাঁদের প্রতিটি কাজ, যতই সাধারণ হোক, আল্লাহর নামে করা। খাওয়া, স্কুলে যাওয়া বা চাকরি করা—যদি নিয়ত আল্লাহর জন্য হয়, তবে তা ইবাদত হয়ে ওঠে।

মনে রাখতে হবে, আমাদের সব কাজ যদি আমরা আল্লাহকে স্মরণে রেখে সম্পন্ন করি, তবে দুনিয়ার যাবতীয় ব্যর্থতাও আমাদের ক্ষতি করবে না। আল্লাহ আমাদের যথাযথ প্রতিদান দেবেন, এই প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন।

সূত্র: ইসলাম অনলাইন ডট নেট

আরও পড়ুন