মুসলিম নারী ক্যালিগ্রাফারদের গল্প

সুরাইয়া সৈয়দ স্যান্ডার্সের আঁকা একটি ‘ইজাযতনামা’ছবি: মুসলিম হেরিটেজ

একটি কলম, কিছু কালি আর কাগজ—এই সাধারণ উপকরণ দিয়ে মুসলিম নারীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সৃষ্টি করেছেন অপূর্ব শিল্প। ক্যালিগ্রাফি বা হাতের লেখার এই শিল্পে তাঁরা শুধু কোরআনের আয়াত বা হাদিসের বাণীই লেখেননি, বরং নিজেদের মেধা, ধৈর্য আর বিশ্বাসের গল্পও ফুটিয়ে তুলেছেন।

হিলাল কাজানের ফিমেল ক্যালিগ্রাফার্স: পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট বইটি এই নারীদের গল্প নিয়ে এসেছে, যাঁরা ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসে কলমের মাধ্যমে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু কারা এই নারী ক্যালিগ্রাফার? কীভাবে তাঁরা সমাজের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শিল্পের শিখরে উঠেছেন?

ক্যালিগ্রাফি হলো এমন একটি পেশা, যেখানে ঠিক হাদিস, তাফসির বা ফিকহর মতো ‘ইজাজা’র প্রয়োজন হয়। এই শিল্পে নারীদের অবদান ইতিহাসের প্রথম দিন থেকেই ছিল।
বেতুল ইপশিরলি আরগিত, গবেষক, বোগাজিচি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্তাম্বুল
ক্যালিগ্রাফির ইতিহাসে নারীর পথচলা

ইসলামি সভ্যতায় ক্যালিগ্রাফি শুধু শিল্প নয়, এটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি প্রতীক। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত বোগাজিচি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বেতুল ইপশিরলি আরগিত বইটির পর্যালোচনায় বলেন, ক্যালিগ্রাফি হলো এমন একটি পেশা, যেখানে ঠিক হাদিস, তাফসির বা ফিকহর মতো ‘ইজাজা’র (আনুষ্ঠানিক অনুমোদন) প্রয়োজন হয়। এই শিল্পে নারীদের অবদান ইতিহাসের প্রথম দিন থেকেই ছিল।

হিলাল কাজান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, প্রথম নারী ক্যালিগ্রাফার ছিলেন শিফা বিনতে আবদুল্লাহ, যিনি হজরত উমর (রা.)–এর সময়ে ক্যালিগ্রাফির শিক্ষক ছিলেন। তিনি শুধু লিখতে ও পড়তে জানতেনই না, হজরত উমরের কন্যা হাফসা বিনতে উমরকেও (রা.) শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই যাত্রা অব্যাহত থাকে আব্বাসি, উমাইয়া, সাফাভি, মোগল ও ওসমানি যুগে, যেখানে নারীরা বাগদাদ, দামেস্ক, সমরখন্দ থেকে আন্দালুসিয়া পর্যন্ত কলমের জাদু দেখিয়েছেন।

বইয়ের প্রচ্ছদ
আরও পড়ুন
নারী ক্যালিগ্রাফারদের জগৎ

ইসলামের ইতিহাসে নারী ক্যালিগ্রাফারদের সংখ্যা নিয়ে তথ্য সীমিত। ‘তুহফে–ই খাত্তাতিন’ বইয়ে মুস্তাকিমজাদে সুলায়মান সাদউদ্দিন এবং সন হাত্তাৎলার বইয়ে ইবনুল এমিন মাহমুদ কামাল মাত্র ২০ জন নারী ক্যালিগ্রাফারের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হিলাল কাজান তাঁর গবেষণায় ৩০ জনের তথ্য তুলে এনেছেন। তিনি বলেন, আন্দালুসিয়ার উমাইয়া রাষ্ট্রে হাজারো নারী ক্যালিগ্রাফার ছিলেন, কিন্তু গোপনীয়তা ও বিনয়ের কারণে তাঁদের অনেকের নাম ইতিহাসে হারিয়ে গেছে।

ইতিহাসের খ্যাতিমান ক্যালিগ্রাফার হলেন ‘ফাদল’, যিনি দশম শতাব্দীতে কায়রাওয়ানে কোরআনের একটি কপি লিখেছিলেন। কোরআনের কপিটি আজও সংরক্ষিত আছে। যেখানে ফাদল লিখেছেন, ‘যে এই কোরআন পড়বে, সে আমার জন্য দোয়া করুক।’ আরেকজন উল্লেখযোগ্য নারী আসমা ইবরেত, ওসমানি যুগের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার। তিনি সুলতান সেলিম তৃতীয়ের সময়ে ‘হিলিয়া-ই শরিফ’ লিখেছিলেন, যা এখন তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে রাখা আছে।

আন্দালুসিয়ার উমাইয়া রাষ্ট্রে হাজারো নারী ক্যালিগ্রাফার ছিলেন, কিন্তু গোপনীয়তা ও বিনয়ের কারণে তাঁদের অনেকের নাম ইতিহাসে হারিয়ে গেছে।
রাজপ্রাসাদ থেকে সাধারণ জীবন

নারী ক্যালিগ্রাফাররা বিভিন্ন পটভূমি থেকে এসেছেন। অনেকে ছিলেন রাজপ্রাসাদের সদস্য, যেমন সাফাভি শাসক শাহ ইসমাইলের কন্যা সুলতানেম বানু বা কাজার শাসক ফতহ আলী শাহের কন্যা উম্মে সালামা। ‘জেনান হোশনুভিস’ বইয়ে আজরা আকিকি বাখশায়িশি লিখেছেন, এই নারীরা রাজপ্রাসাদে উচ্চশিক্ষা পেয়েছিলেন, যা তাঁদের শিল্পে পারদর্শী করেছিল।

কিন্তু শুধু রাজপ্রাসাদ নয়, সাধারণ পরিবারের নারীরাও ক্যালিগ্রাফিতে নাম করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, উম্মি খাতুন, ষোড়শ শতাব্দীর উসমানী যুগে গালিপোলির এক কামারের কন্যা। তিনি প্রমাণ করেন, শিল্প শুধু শহর বা অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

আসমা ইবরেত হানিমের আঁকা ‘দালাইল আল–হায়রাত’র দুটি পৃষ্টা
ছবি: মুসলিম হেরিটেজ
আরও পড়ুন
আধুনিক যুগে

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারী ক্যালিগ্রাফারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে কবরস্থানের গবেষণায় অনেক নারী ক্যালিগ্রাফারের সমাধিফলক পাওয়া গেছে।

আধুনিক যুগে সুরাইয়া সৈয়দ স্যান্ডার্সের মতো নারীরা ক্যালিগ্রাফির নতুন দিগন্ত খুলেছেন। সুরাইয়া লন্ডনে জন্মগ্রহণ করলেও মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় ক্যালিগ্রাফি শিখেছেন এবং তুরস্কের হাসান চেলেবির কাছে ইজাজা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ক্যালিগ্রাফি তাঁর বিশ্বাস প্রকাশের একটি মাধ্যম।

হিলাল কাজান নিজেও একজন ক্যালিগ্রাফার। তিনি ইস্তাম্বুলের সুলায়মানিয়া মসজিদের গম্বুজের লেখা দেখে ক্যালিগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হন। মুসেররেফ চেলেবি এবং হাসান চেলেবির কাছে শিক্ষা নিয়ে তিনি ইজাজা পান। তাঁর বইয়ে নিজের গল্পের পাশাপাশি তিনি অন্য নারীদের গল্প তুলে ধরেছেন।

তাবাকাত বা জীবনীসংকলনের শৈলীতে লেখা এই বইটি ইতিহাসের বিস্তৃত ভূগোল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নারীদের কথা বলে।
কেন এই বই গুরুত্বপূর্ণ

হিলাল কাজানের বইটি ইসলামি ক্যালিগ্রাফির ইতিহাসে নারীদের অবদানের একটি বিরল দলিল। যুক্তরাজ্যের ফাউন্ডেশন ফর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড সিভিলাইজেশনের সিনিয়র গবেষক এবং তুরস্কের ফাতিহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক সালিম আইদুজ বলেন, এটি নারীদের শিল্প, শিক্ষা এবং সমাজে অংশগ্রহণের প্রমাণ।

বইটি দুটি ভাগে বিভক্ত—প্রথম ভাগে প্রাথমিক ইসলামি যুগ থেকে ওসমানি আমল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ভাগে আধুনিক যুগের নারী ক্যালিগ্রাফারদের গল্প। তাবাকাত বা জীবনীসংকলনের শৈলীতে লেখা এই বইটি ইতিহাসের বিস্তৃত ভূগোল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নারীদের কথা বলে।

বইটিতে নারীদের ক্যালিগ্রাফির নমুনাও সংযুক্ত করা হয়েছে, যা শিল্পের বিবর্তন দেখায়। যেমন, ফাদলের কোরআনের পাণ্ডুলিপি বা আসমা ইবরেতের হিলিয়া-ই শরিফ এই শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন।

লেখক হিলাল কাজানের আঁকা ‘আসমা–উল–হুসনা’
ছবি: মুসলিম হেরিটেজ

বাংলাদেশেও ক্যালিগ্রাফির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ঢাকার মসজিদগুলোর গায়ে আরবি ক্যালিগ্রাফি আমাদের শিল্পের ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু নারীদের অংশগ্রহণ এখনো সীমিত। হিলাল কাজানের এই বই আমাদের তরুণীদের জন্য একটি প্রেরণা হতে পারে। যেমন সুরাইয়া সৈয়দ একটি ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেও ক্যালিগ্রাফিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তেমনি বাংলাদেশের নারীরাও এই শিল্পে নিজেদের ছাপ রাখতে পারেন।

ফিমেল ক্যালিগ্রাফার : পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, বুইউকশেহির বেলেদিয়েসি কুলতুর প্রকাশনী, ইস্তাম্বুল, জানুয়ারি ২০১০

 সূত্র: মুসলিম হেরিটেজ ডটকম

আরও পড়ুন