মহানবী (সা.)-র জীবনের শেষ ১৫ দিন

বিদায় হজ থেকে ফেরার পরই রাসুল (সা.) এমনভাবে কথা বলছিলেন, বোঝা যেত, তিনি আর বেশি দিন নেই। এ সময় ওহি আসে, ‘তোমাদের জন্য আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করেছি’ (সুরা মা-ইদা, আয়াত ৩)। বুদ্ধিমান সহচরগণ বুঝতে পেরেছিলেন, এটি নবীজির (সা.) দায়িত্ব সম্পন্ন হওয়ারও ঘোষণা। যখন পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়, তখন অপূর্ণতার শুরু হয়। (সিরাতে ইবনে কাসির, ৪/৪২৭)

ইতিহাসবিদ ওয়াকিদি (আল-মাগাজি, ৭৩৩), ইবনে সা’দ (আত-তাবাকাত আল-কুবরা, ২/১৮৩), ইবনে হিশাম (আস-সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ২/৬৪২) এবং ইবনে কাসির (আস-সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ৪/৪৪৩) একমত যে নবীজি সফরের শেষ সপ্তাহে অসুস্থ বোধ করেন, সোমবার সাহাবিদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন, বুধবার থেকে তীব্র মাথাব্যথা ও জ্বর অনুভব করেন এবং এরপর তিনি মাত্র ১৩ দিন জীবিত ছিলেন। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, নবীজি (সা.)১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। (আর-রওযুল উন্‌ফ, ৪/৪৩৯-৪৪০; ইবনে কাসির, ৪/৫০৯; ফাতহুল বারি, ৮/১৩০)

আধুনিক ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন সোমবার, তবে হিজরি তারিখ হয় ১৪ রবিউল আউয়াল। চান্দ্রবর্ষভিত্তিক হিজরি মাসের শুরু-শেষ পূর্বনির্ধারিত না থাকায় ২ দিন ব্যতিক্রম হওয়া বিচিত্র নয়। আমরা তাই ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়ালকে (৮ জুন ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) সোমবার ধরে শেষ ১৫ দিন হিসাব করেছি।

আরও পড়ুন

প্রথম দিন: ২৮ সফর, ২৫ মে, সোমবার

উহুদ যুদ্ধের আট বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ এ দিন তিনি শহীদদের জন্য এমন করে প্রার্থনা করছিলেন, যেন তিনি শিগগিরই তাঁদের সঙ্গে মিলিত হবেন কিংবা যেন জীবিত প্রিয়দের শেষ বিদায় জানাচ্ছেন। তিনি মসজিদের মিম্বরের দিকে এগিয়ে যান। সমবেত সাহাবিদের (রা.) বলেন, আমি তোমাদের সত্যায়ন করছি। বেহেশতে কাউসারের কিনারে আবার তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস ২২৯৬)

তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে বাহিনী পাঠাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। সাহাবাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং দ্রুত যাত্রা শুরু করতে আদেশ দেন। সাহাবিরা তৈরি হতে থাকেন।

দ্বিতীয় দিন: ২৯ সফর, ২৬ মে, মঙ্গলবার

ওসামা ইবনে জায়েদকে ডেকে মহানবী (সা.) বলেন, ‘ওসামা, আল্লাহর নামে ও তাঁর আশীর্বাদে যাত্রা শুরু করো। তোমার পিতার মৃত্যুর স্থানে যাবে এবং শত্রুদের আঘাত করবে। তোমাকে বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করছি। দ্রুত উবনাবাসীদের আক্রমণ করো।…অগ্রগামী গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দাও।’ (ওয়াকিদি, আল-মাগাজি, ৭৩৩)

উবনা জর্ডানের বালকা অঞ্চলে অবস্থিত। মু’তার যুদ্ধ যেখানে সংঘটিত হয়েছে, তার কাছাকাছি। সেখানে এখনো মুতার যুদ্ধের সেনানায়ক শহিদ জাফর ইবনে আবু তালিব (রা)-র সমাধি রয়েছে। (মুজাম মা ইস্তাজাম, ১/১০১; মুজাম আল-বুলদান, ১/৭৯)

আরও পড়ুন

তৃতীয় দিন: ৩০ সফর, ২৭ মে, বুধবার

মহানবী (সা.)-র শারীরিক অসুস্থতা স্পষ্ট ওয়ে হঠে। প্রাথমিক আলামত এভাবে প্রকাশ পায় যে মধ্যরাতে নবীজি (সা.) তাঁর সেবাদাস আবু মুওয়াইবাহকে মদিনার কবরস্থানে নিয়ে যেতে বলেন, যার নাম বাকি আল-গারকাদ। সেখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, যেন সমাহিতদের ক্ষমা করেন। পরে ঘরে ফিরে আসেন। ভোর হলে মৃত্যুরোগের তীব্রতা দেখা দেয়। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/৬৪২; সিরাতে ইবনে কাসির, ৪/৪৪৩)

আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তিনি বাকি থেকে ফিরে এসে দেখেন, আমি অসুস্থ, মাথার ব্যথায় কাতরাচ্ছি। বললাম, আমার মাথায় কী যে যন্ত্রণা। তিনি বললেন, না, আমার মাথায় অনেক বেশি যন্ত্রণা। আয়েশা, আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা।’ (সুনানু ইবনে মাজাহ, ১,৪৬৫)

তাঁর জ্বর বেড়ে যায়, তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ওদিকে মুসলিম সেনাদল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে ওসামা ইবনে জায়েদের নেতৃত্বে।

চতুর্থ দিন: ১ রবিউল আউয়াল, ২৮ মে, বৃহস্পতিবার

নবীজি (সা.) ওসামা ইবনে জায়েদকে ডাকেন এবং নিজ হাতে তার পতাকা বাঁধেন। তারপর বলেন, ‘ওসামা, আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করো, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো। যুদ্ধ করো তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহকে অবিশ্বাস করে। প্রতারণা কোরো না, শিশু বা নারীকে হত্যা কোরো না। শত্রুর সাক্ষাতের অপেক্ষা কোরো না; জানো তো না যে, তাদের ফাঁদে পড়ছ কি না তোমরা। প্রার্থনা করো, আল্লাহ, শত্রুদের থেকে আমাদের রক্ষা করুন, তাদের শক্তি আমাদের থেকে দূরে রাখুন। যদি তারাই তোমাদের মুখোমুখি হয় এবং তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে ধীর–স্থিরতা বজায় রাখো এবং অন্তর্বিবাদ কোরো না, যাতে তোমরা ব্যর্থ না হও এবং তোমাদের শক্তি ক্ষয় না হয়। প্রার্থনা করো, আল্লাহ, তোমার দাস আমরা এবং তারাও। আমাদের মাথা এবং তাদের মাথা—সবই তোমার হাতে। তুমিই তাদের পরাজিত করতে পারো। জানো তো, তরবারির ঝলকের নিচেই বেহেশত। ওসামার হাতে পতাকা দিয়ে বলেন, আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করো এবং উবনার অধিবাসীদের ওপর আক্রমণ চালাও।’ (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৮৫৭; সুনান আবু দাউদ, হাদিস ২৬১৬)

নবীজি (সা.) ওসামাকে বলেন জুরফ এলাকায় শিবির স্থাপন করতে। এখনো যারা তৈরি হতে পারেনি, যেন সেখানে গিয়ে তাঁরা বাহিনীতে যোগদান করতে পারেন এবং একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাদল গঠন হয়। ওসামা পতাকা নিয়ে বেরিয়ে যান। তিনি পতাকাটি বুরাইদা ইবনে হাসিব আসলামিকে দেন, তিনি তা ওসামার বাড়িতে নিয়ে যান। (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস ৪৪৬৮; সিরাতে ইবনে কাসির, ৪/৪৪১)

উল্লেখ্য, ওয়াকিদি ও ইবনে সাদ দুজনেরই মত হলো, নবীজি (সা.) অসুস্থ হয়েছেন ২৯ সফর বুধবার এবং ৩০ সফর বৃহস্পতিবার ওসামা ইবনে জায়েদকে পতাকা বেঁধে দেন। কিন্তু ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ধরলে ৩০ সফর হয় বুধবার, বৃহস্পতিবার ১ রবিউল আউয়াল।

আমাদের ধারণা, নবীজির (সা.) অসুস্থতা যেমন মঙ্গলবার (২৯ সফর) দিবাগত রাতে দেখা দিয়েছে, তেমনি পতাকা বাঁধার ঘটনাও হয়েছে বুধবার সন্ধ্যার পরে, যাকে বৃহস্পতিবার ধরা হয়েছে। যেহেতু হিজরি হিসেবে সূর্যাস্তের পরে নতুন দিন হিসাব করা হয়, ফলে পরবর্তীকালের হিসাবে তারিখ ও বার আগপিছ হতে পারে।

আরও পড়ুন

পঞ্চম দিন: ২ রবিউল আউয়াল, ২৯ মে, শুক্রবার

অসুস্থতা বাড়তে থাকে। তিনি ঠান্ডা পানি দিয়ে তাঁকে গোসল করিয়ে দিতে বলেন। গোসলের পর শরীরের তাপ কমেছে অনুভব করলে চাচাতো ভাই ফজল ইবনে আব্বাসকে বলেন তাঁকে হাত ধরে মসজিদে নিয়ে যেতে। মাথায় বাঁধা ব্যান্ডেজ। মিম্বরে বসে লোকজনকে ডাকতে বলেন। সাহাবিগণ ছুটে আসেন। কেননা, জীবনভর তিনি তাঁদের শিখিয়ে যাচ্ছিলেন কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে।

নবীজি (সা.) আবেগময় ভাষায় তাঁদের বলেন, ‘আমি আল্লাহর প্রশংসা করি, যিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। যদি আমি তোমাদের মধ্যে কাউকে তার পিঠে আঘাত করে থাকি, তবে সে এসে আমাকে পিঠে আঘাত করে প্রতিশোধ নিক। যদি আমি কাউকে অপমান করে থাকি, তবে সে এসে আমাকে অপমান করুক। বিতর্ক করা আমার স্বভাবের অংশ নয়। এটি আমাকে আকৃষ্ট করে না। তোমাদের মধ্যে যে আমার প্রতি সবচেয়ে প্রিয়, সে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তা সমাধান করে। এর মাধ্যমে, সে আমাকে মুক্তি দেয় এবং কারও অভিযুক্ত না হয়ে আমি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/৩০৪)

মুসলমানরা শহরের প্রান্ত থেকে এবং আশেপাশের স্থান থেকে ওসামা ইবনে জাইদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে শিবিরে আসতে থাকেন। নবীজি (সা.) এই সৈন্যদলে মুহাজির ও আনসারদের প্রবীণ ও নির্বাচিত সাহাবিদেরও শামিল করেন। যাদের মধ্যে সবচে’ উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওমর (রা.)। এ ছাড়া আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রা.) ও সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস(রা.)। ফলে ওসামার নেতৃত্বে আপত্তি ওঠে। কেউ কেউ বলেন, ‘এই ছেলেটি প্রাচীন মুহাজিরদের ওপর নিয়োগ করা হয়েছে?” ওসামার বয়সও ছিল কম—মাত্র সতেরো বছর। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/৬৫০)

নবীজির (সা.) অসুস্থতার কারণে তাঁরা যাত্রা নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। সেদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত এ-অবস্থা চলতে থাকে।

আরও পড়ুন