অর্থসংকটে ইসলামে সংযমের শিক্ষা

ছবি: পেক্সেলস

আর্থিক সংকট মানবজীবনের একটি কঠিন ও বাস্তব পরীক্ষা। মূল্যস্ফীতির চাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, ঋণের বোঝা পরিবার ও সমাজকে নীরবে পিষে ফেলছে।

এসব সংকট মানুষের মনস্তত্ত্ব, নৈতিকতা ও বিশ্বাসের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। হতাশা, দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে।

কিন্তু ইসলাম অর্থনৈতিক সংকটকে স্রেফ দুর্ভোগ হিসেবে নয়; আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটি পরিশুদ্ধকারী পরীক্ষা হিসেবে দেখে। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষের ইমান, ধৈর্য, সংযম ও তাওয়াককুলের বাস্তব রূপ প্রকাশ পায়।

আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয় এবং ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।
কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয় এবং ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)

এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক টানাপড়েন আল্লাহর নির্ধারিত পরীক্ষারই অংশ। আর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চাবিকাঠি হল ধৈর্য।

আল্লাহ আরও বলেন, ‘যারা বিপদে পড়লে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই তাঁরই কাছে ফিরে যাব।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬)

অর্থনৈতিক সংকটে যখন মানুষ মনে করে সব কিছু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন এই বিশ্বাস তাকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে—যিনি রিজিকের একমাত্র মালিক।

আরও পড়ুন

আল্লাহ তাআলা আরও সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিজিক দান করেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না।’ (সুরা তালাক, আয়াত: ২–৩)

এই আয়াত অর্থনৈতিক দর্শনের একটি মৌলিক নীতি স্থাপন করে—রিজিক যেমন পরিশ্রমের ফসল তেমনি আল্লাহভীতির সঙ্গেও তা গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

নবীজির (সা.) জীবনে অর্থনৈতিক সংকট

মহানবীর জীবন ছিল অর্থনৈতিক কষ্ট ও ধৈর্যের এক জীবন্ত দলিল। মক্কায় কাফেরদের সামাজিক বয়কটের সময় তিনি ও তাঁর পরিবার মাসের পর মাস ক্ষুধা সহ্য করেছেন, শিশুদের কান্না আকাশে ভারী করেছে।

আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমরা কখনো পরপর দু’দিন পেট ভরে খেতে পারিনি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৪১৪)

একাধিক দিন নবীজির ঘরে চুলা জ্বলেনি। তবু দারিদ্র্য কখনো তাঁকে আল্লাহর ওপর আস্থাহীন করেনি। বরং সংকটের মধ্যেই তিনি উম্মতকে ধৈর্য ও আত্মমর্যাদার শিক্ষা দিয়েছেন।

একাধিক দিন তাঁর ঘরে চুলা জ্বলেনি। তবু এই দারিদ্র্য কখনো তাঁকে আল্লাহর ওপর আস্থাহীন করেনি। বরং সংকটের মধ্যেই তিনি উম্মতকে ধৈর্য ও আত্মমর্যাদার শিক্ষা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘ধৈর্যশীল ব্যক্তির জন্য কত সুন্দর প্রতিদান! যে ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে ধৈর্য দান করেন। আর ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও বড় কোনো নেয়ামত কাউকে দেওয়া হয়নি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৪৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,০৫৩)

সংযম ও মিতব্যয়: ইসলামে আর্থিক নৈতিকতা

অর্থনৈতিক সংকটে ইসলাম অপচয় ও বিলাসিতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘খাও-পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)

ইসলাম মানুষকে ভোগবিমুখ করে না; সীমার মধ্যে থাকতে শেখায়। অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, লোক-দেখানো জীবনধারা ও অহংকার সংকটকে আরও তীব্র করে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মিতব্যয়ী ব্যক্তির জন্য আল্লাহ সম্পদ বাড়িয়ে দেন।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ১৭,৪৫৮)

আরও পড়ুন

এ কারণেই ইসলাম সুদ, জুয়া, ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ঋণ নেওয়া যদি অনিবার্য হয়, তবে তা শোধ করার দৃঢ় নিয়ত থাকতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করে তা শোধ করার নিয়ত রাখে, আল্লাহ তার জন্য সাহায্য করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩৮৭)

সংকটে দান ও সহযোগিতা

অর্থনৈতিক সংকটের সময় ইসলাম সমাজকে আত্মকেন্দ্রিক হতে দেয় না। যাকাত, সদকা ও দানের মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ সচল রাখতে নির্দেশ দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ সেই শস্যের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মে; প্রতিটি শীষে একশত দানা।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬১)

রাসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘সদকা সম্পদ কমায় না; বরং বাড়ায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৮৮)

ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও বড় কোনো নেয়ামত কাউকে দেওয়া হয়নি।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৪৬৯

এই শিক্ষা সংকটকালে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দান সমাজের দুর্বল অংশকে বাঁচায় এবং ধনীর হৃদয়কে কৃপণতা থেকে মুক্ত করে।

সংকট থেকে উত্তরণের পথ

আজকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের করণীয় সুস্পষ্ট—ধৈর্য ধারণ করা, অপচয় পরিহার করা, হালাল উপার্জনে অটল থাকা এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা। তওবা, ইস্তিগফার ও দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত আহ্বান করা।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বলে, আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজী লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ূম ওয়া আতূবু ইলাইহি—তার গুনাহ মাফ হয়, যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে থাকে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১,৫১৭; তিরমিজি, হাদিস: ৩,৫৭৭)

অর্থনৈতিক সংকট আমাদের ঈমানের মানদণ্ড। তা আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ। ধৈর্য, সংযম ও তাওয়াককুলের পথে অবিচল থাকলে আল্লাহ–তাআলা অবশ্যই ফারাজ—স্বস্তি ও প্রশস্ততা দান করবেন। নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি।

ইফতেখারুল হক হাসনাইন : আলেম ও লেখক

আরও পড়ুন