মহানবীর আগমন নিয়ে ইহুদি পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের সময় সমসাময়িক ইহুদি পণ্ডিতদের মধ্যে তাঁর আগমন সম্পর্কে পূর্বাভাস ও ভবিষ্যদ্বাণী ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ পূর্বাভাসগুলো তাঁরা দেন তাঁদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে এবং তাঁর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা ও চিহ্নের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পায়। এ ভবিষ্যদ্বাণীগুলো মক্কা ও মদিনার ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর নবুয়তের সর্বজনীন তাৎপর্যকে তুলে ধরে।
মক্কায় ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাস
মহানবীর জন্মের সময় মক্কায় ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর আগমনের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী প্রচারিত হয়। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, একজন ইহুদি ব্যবসায়ী মক্কায় কুরাইশদের মজলিশে ঘোষণা করেন, ‘আজ রাতে একজন নবী জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁর কাঁধে একটি বিশেষ চিহ্ন রয়েছে, যা ঘোড়ার লেজের মতো ক্রমাগত চুল দ্বারা চিহ্নিত।’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৭০, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)
মক্কার ইহুদি পণ্ডিতেরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত একজন চূড়ান্ত নবীর আগমনের প্রত্যাশা করছিলেন, কিন্তু তাঁর আরব বংশোদ্ভূত হওয়ার বিষয়টি তাঁদের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত।
এ চিহ্ন ছিল নবুয়তের মোহর (খাতামুন নুবুওয়া), যা পরবর্তী সময়ে তাঁর কাঁধে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই ইহুদি পণ্ডিত আরও বলেন, ‘এই নবী দুই দিন স্তন্য পান করবেন না। কারণ, একটি জিন তাঁর মুখে আঙুল ঢুকিয়ে তাঁকে বাধা দেবে।’
এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়। কারণ, মহানবীর জন্মের পর তাঁর মা আমিনা বর্ণনা করেন যে তিনি প্রথম দুই দিন স্তন্য পান করেননি। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৭০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
এই ইহুদি পণ্ডিত আমিনার কাছে গিয়ে মহানবীর (সা.) পিঠে নবুয়তের মোহর দেখে অভিভূত হন এবং অজ্ঞান হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘নবুয়ত ইসরাইলের (নবী ইয়াকুব) বংশ থেকে চলে গেছে।’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৭১, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)
বোঝা যায়, মক্কার ইহুদি পণ্ডিতেরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত একজন চূড়ান্ত নবীর আগমনের প্রত্যাশা করছিলেন, কিন্তু তাঁর আরব বংশোদ্ভূত হওয়ার বিষয়টি তাঁদের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত।
মদিনায় ইহুদি পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী
মদিনা (তৎকালীন ইয়াসরিব) ছিল ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যেখানে বনু কুরাইজা, বনু নাজির ও বনু কাইনুকা গোত্রের ইহুদিরা বসবাস করতেন। এই সম্প্রদায়ের পণ্ডিতেরাও মহানবীর আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
হজরত হাসান ইবনে সাবিত (রা.), যিনি পরবর্তী সময়ে মহানবীর প্রশংসায় কবিতা রচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন সাত বা আট বছরের ছিলাম, তখন মদিনায় একজন ইহুদি পণ্ডিত ঘোষণা করেন, আহমদের নক্ষত্র উদিত হয়েছে, যিনি এই রাতে জন্মগ্রহণ করেছেন।’ (আবু নু’আইম, দালাইলুন নুবুওয়া, ১/৮০, দারুন নাফাইস, বৈরুত, ১৯৮৬)
এ ঘোষণা মদিনার ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। কারণ, তাঁরা তাওরাতে বর্ণিত একজন নবীর আগমনের বিষয়ে জানতেন।
তিনি হবেন মাঝারি উচ্চতার, চোখে হালকা লালিমা, পরিধেয় সাধারণ কাপড়, গাধায় চড়বেন এবং তাঁর কাঁধে থাকবে তরবারি।আবু নু’আইম, দালাইলুন নুবুওয়া
ইহুদি পণ্ডিতেরা মহানবীর (সা.) শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, তিনি হবেন ‘মাঝারি উচ্চতার, চোখে হালকা লালিমা, পরিধেয় সাধারণ কাপড়, গাধায় চড়বেন এবং তাঁর কাঁধে থাকবে তরবারি।’ (আবু নু’আইম, দালাইলুন নুবুওয়া, ১/৮২, দারুন নাফাইস, বৈরুত, ১৯৮৬)
এই বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তীকালে মহানবীর জীবনে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, তিনি প্রায়ই সাধারণ কাপড় পরতেন এবং যুদ্ধের সময় তরবারি ব্যবহার করতেন। তাঁর গাধায় চড়ার বিষয়টিও হিজরতের সময় এবং অন্যান্য ঘটনায় প্রমাণিত হয়।
ইহুদি পণ্ডিতদের ধর্মগ্রন্থভিত্তিক প্রত্যাশা
ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাসগুলো ছিল তাঁদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া। পবিত্র কোরআন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলে, ‘যারা সেই রাসুলের অনুসরণ করে, সেই উম্মি নবী, যাঁকে তারা তাদের তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যিনি তাদের সৎকাজের নির্দেশ দেন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৫৭)
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক নবীর কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে যদি মুহাম্মদ (সা.) তাঁদের সময়ে আসেন, তবে তাঁরা তাঁর প্রতি ইমান আনবেন এবং তাঁকে সমর্থন করবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৪৪১)
মদিনার বনু কুরাইজা ও বনু নাজিরের ইহুদি পণ্ডিতেরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থে এই নবীর আগমনের সময় ও স্থান সম্পর্কেও জানতেন। তাঁরা বলতেন, ‘এই নবী মক্কা ও ইয়াসরিবের (মদিনা) দিক থেকে আসবেন।’ (আবু নু’আইম, দালাইলুন নুবুওয়া, ১/৮৩, দারুন নাফাইস, বৈরুত, ১৯৮৬)
এই পূর্বাভাসগুলো তাঁর হিজরতের সময় মদিনায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতার পটভূমি তৈরি করে।
অলৌকিক ঘটনা ও তাৎপর্য
মহানবীর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কিছু অলৌকিক ঘটনাও ঘটেছিল, যা ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাসের সত্যতা প্রমাণ করে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর মা আমিনা বর্ণনা করেন, ‘আমি যখন তাঁকে জন্ম দিলাম, তখন একটি নুর (আলো) দেখলাম, যা শামের প্রাসাদগুলোকে আলোকিত করেছিল।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ২, পৃ. ২৭৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
এই নুর তাঁর নবুয়তের সর্বজনীন প্রভাবের প্রতীক ছিল। এ ছাড়া তাঁর জন্মের রাতে আকাশে একটি নক্ষত্রের উদয় হয়েছিল, যা ইহুদি পণ্ডিতেরা ‘আহমদের নক্ষত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
ইহুদি পণ্ডিতদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর আগমনের পূর্বাভাস দিলেও পরবর্তীকালে তাঁর নবুয়তকে অস্বীকার করেন। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, মদিনার একজন ইহুদি পণ্ডিত, তাঁর নাম ইউশা, তিনি বনু আবদুল আশহালের মধ্যে ঘোষণা করেন, ‘একজন নবী এই এলাকা থেকে আসবেন, যিনি জন্ম, পুনরুত্থান, হিসাব, জান্নাত ও জাহান্নামের কথা বলবেন।’ তিনি হাসান ইবনে সাবিতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এই বালক যদি পূর্ণ বয়সে পৌঁছে, তবে সে তাঁকে পাবে।’ (আবু নু’আইম, দালাইলুন নুবুওয়া, ১/৮৪, দারুন নাফাইস, বৈরুত, ১৯৮৬)
কিন্তু যখন মহানবী মদিনায় হিজরত করেন, তখন এই পণ্ডিত তাঁকে অস্বীকার করেন। সে সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি কিতাব এল, যা তাদের কাছে থাকা কিতাবের সত্যতা নিশ্চিত করে, তখন তারা তা অস্বীকার করল, যদিও তারা আগে এর জন্য প্রার্থনা করত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৮৯)
মদিনার বনু কুরাইজা ও বনু নাজিরের ইহুদি পণ্ডিতেরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থে এই নবীর আগমনের সময় ও স্থান সম্পর্কেও জানতেন। তাঁরা বলতেন, ‘এই নবী মক্কা ও ইয়াসরিবের (মদিনা) দিক থেকে আসবেন।’
সালমান ফারসির সাক্ষ্য
ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের পূর্বাভাসের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো সালমান ফারসির (রা.) জীবনী। তিনি একজন ফারসি ছিলেন, যিনি খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে মহানবীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারেন। তাঁর একজন শিক্ষক তাঁকে বলেন, ‘একজন নবী আসবেন আরব ভূমিতে, যিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, কিন্তু সদকা নেবেন না এবং তাঁর কাঁধে নবুয়তের মোহর থাকবে।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/২৪০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
সালমান মদিনায় এসে মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর কাঁধে নবুয়তের মোহর দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ ঘটনা ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের ধর্মগ্রন্থভিত্তিক পূর্বাভাসের সত্যতাকে আরও জোরদার করে।
কোরআনেও বলা হয়েছে, ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম বলেছিলেন, হে বনি ইসরাইল, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসুল, আমার পূর্বের তাওরাতের সত্যতা নিশ্চিতকারী এবং আমার পরে একজন রাসুলের সুসংবাদদাতা, যাঁর নাম আহমদ।’ (সুরা সাফ, আয়াত: ৬)
তবে অনেক ইহুদি পণ্ডিত তাঁর নবুয়তকে অস্বীকার করেন, যা ছিল তাঁদের হিংসা ও গোঁড়ামির ফল। মহানবীর জন্মের সময় ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাস তাঁর নবুয়তের একটি অলৌকিক ও ঐতিহাসিক দিক প্রকাশ করে। মক্কায় নবুয়তের মোহর ও মদিনায় ‘আহমদের নক্ষত্র’–সম্পর্কিত ঘোষণা তাঁর আগমনের পূর্বাভাসকে নিশ্চিত করে।