নিজেকে অযোগ্য মনে হলে ইসলাম কী বলে

জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন আমরা নিজেকে অপর্যাপ্ত মনে করি। মনে হয়, আমরা যথেষ্ট ভালো নই, আমাদের যোগ্যতা নেই সুখী জীবনের, সুন্দর সম্পর্কের কিংবা আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের। এই অনুভূতি আমাদের মনের গভীরে শিকড় গেড়ে বসে, আমাদের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেয়।

কিন্তু কেন আমরা এমন ভাবি? আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন সর্বোত্তম আকৃতিতে, তবু কেন আমরা নিজেদের প্রতি অসন্তুষ্ট? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখি, আমাদের শৈশব, সমাজ ও শয়তানের প্রভাব আমাদের মনে এই নেতিবাচক ধারণা গেঁথে দেয়। তবে আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া এবং কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে নিজেকে গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা এ অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে পারি। কীভাবে? আসুন আলোচনা করা যাক।

নিজেকে অপর্যাপ্ত ভাবা মানে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অবিশ্বাস করা। আমাদের প্রথম কাজ হলো নিজেকে ভালোবাসা, নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

১. আল্লাহ আপনাকে সর্বদা যথেষ্ট মনে করেন

আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন সর্বোত্তম আকৃতিতে। কোরআনে তিনি বলেছেন, ‘আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে।’ (সুরা ত্বিন, আয়াত: ৪)

আমাদের শরীর, মন, ব্যক্তিত্ব—সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি এতে কোনো ত্রুটি রাখেননি। আমাদের চেহারা, প্রতিভা, এমনকি আমাদের দুর্বলতাগুলোও আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ। তাই নিজেকে অপর্যাপ্ত ভাবা মানে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অবিশ্বাস করা। আমাদের প্রথম কাজ হলো নিজেকে ভালোবাসা, নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যদি আমরা নিজেকে গ্রহণ করতে পারি, তবে আমরা আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের প্রতি শুকরিয়া আদায় করতে পারি।

আরও পড়ুন

২. শয়তান চায়, নিজেকে অযোগ্য মনে করুন

যখনই আমাদের মনে নেতিবাচক চিন্তা আসে, তখন প্রায়ই এর পেছনে শয়তানের প্ররোচনা কাজ করে। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি কি তোমাদের নির্দেশ দিইনি, শয়তানের অনুসরণ কোরো না? কারণ, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৬০)

শয়তান আমাদের মনে নিরাশা ও হতাশার বীজ বপন করে, যাতে আমরা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হই। যখন আমরা মনে করি, আমরা যথেষ্ট ভালো নই, তখন শয়তান আমাদের দুর্বলতাকে কাজে লাগায়।

এ পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া, নেক আমল করা এবং শয়তানের প্ররোচনার বিরুদ্ধে লড়াই করা। নিয়মিত নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত এবং জিকির আমাদের মনকে শান্ত করে এবং শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে।

কিছু মানুষ তাদের নিজেদের দুর্বলতার প্রতি অসন্তুষ্ট, তাই তারা অন্যদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে।
ড. চিপ ডড, ভয়েস অব দ্য হার্ট, ২০১৪

৩. যারা আপনাকে অযোগ্য মনে করায়, তারা নিজেরা দুর্বল

অনেক সময় আমাদের চারপাশের মানুষ আমাদের অযোগ্য বোধ করায়। তাদের কথা বা আচরণ আমাদের মনে আঘাত করে। কিন্তু বুঝতে হবে, যারা আমাদের প্রতি নেতিবাচক আচরণ করে, তারা নিজেরাই দুর্বল। ড. চিপ ডড বলেন, ‘কিছু মানুষ তাদের নিজেদের দুর্বলতার প্রতি অসন্তুষ্ট, তাই তারা অন্যদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে।’ (ডড, সি., ভয়েস অব দ্য হার্ট, ২০১৪, পৃ. ৪৫, সেজ হিল রিসোর্স)

এরা করুণার যোগ্য। একই সঙ্গে নিজেদের সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি। যদি এই নেতিবাচক মানুষ আমাদের নিকটাত্মীয়ও হয়, তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে দূরত্ব রাখতে হবে। আর যদি তারা আমাদের জীবনের অংশ না হয়, তবে তাদের থেকে দূরে থাকাই ভালো।

৪. জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা

আমরা প্রায়ই অন্যদের মতামতের ওপর ভর করে নিজেদের মূল্যায়ন করি। কিন্তু কোরআন আমাদের শেখায়, আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সম্পদ বা সন্তান তোমাদের আমার নিকটবর্তী করে না। কিন্তু যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে, তারাই তাদের কাজের জন্য বহুগুণ পুরস্কার পাবে।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ৩৭)

অন্যরা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবে, তা নিয়ে চিন্তা করলে আমরা নিজেদের মানসিক শান্তি হারাব। তাই আমাদের মনোযোগ থাকা উচিত শুধু আল্লাহর দিকে। অন্যদের মতামত শুনতে হবে, তবে তা কোরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেই গ্রহণ করা উচিত।

৫. জীবনের প্রতিটি ঘটনা একটি পরীক্ষা

জীবনে যখন আমরা দুঃখ-কষ্ট বা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হই, তখন মনে হয়, আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন না। কিন্তু কোরআন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষতি, জীবনের ক্ষতি এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬)

জীবনের প্রতিটি কষ্ট আমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করার পরীক্ষা। যদি ধৈর্য ধরে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি, তবে আমরা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হব। আল্লাহ আমাদের কখনো এমন পরীক্ষায় ফেলেন না, যা আমরা সহ্য করতে পারি না। তাই প্রতিকূলতার মুখে হতাশ না হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া উচিত।

আরও পড়ুন
আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষতি, জীবনের ক্ষতি এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ দাও।
সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬

৬. নিজেকে ভালোবাসা মানে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা

আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও, আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য আরও বাড়িয়ে দেব। কিন্তু যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।’ (সুরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৭)

আমাদের শরীর, স্বাস্থ্য, সম্পদ—সবকিছুই আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত। যদি আমরা নিজেকে ভালো না বাসি, তবে আমরা আল্লাহর দেওয়া এই নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। নিজেকে ভালোবাসা শুরু হয় কৃতজ্ঞতা থেকে। আমাদের যা আছে, তা নিয়ে শুকরিয়া আদায় করতে হবে।

৭. অন্যদের প্রতি ভালো ধারণা আত্মমর্যাদা বাড়ায়

সম্পর্ক আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘এক নারী তাঁর নামাজ, রোজা এবং দানখয়রাতে ভালোই ছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে খারাপ আচরণের কারণে তিনি জাহান্নামে যাবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০২৬)

যদি অন্যদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করি, তবে তা নিজেদের মানসিক শান্তিই বিনষ্ট করে। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘ঈমানদারগণ, অনেক অনুমান থেকে বিরত থাকো। কারণ, কিছু অনুমান পাপ।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২)

অন্যদের প্রতি ভালো ধারণা রাখলে আমাদের মন শান্ত থাকে এবং আমাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

সারকথা

আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছা তোমাদের বোঝা হালকা করা। কারণ, মানুষকে দুর্বল সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ২৮)

মাঝেমধ্যে মনে হতে পারে, আমি যথেষ্ট ভালো নই, যোগ্য নই। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই অনুভূতির মুখোমুখি হয়ে আমাদের আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। কোরআন ও সুন্নাহ বলছে, আমরা যেন নিজেদের ভালোবাসতে শিখি এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখি। নিজেকে ভালোবাসা ও আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করে তুলবে।

আরও পড়ুন