নসিহত নাকি তিরস্কার: কোনটির প্রভাব বেশি

ছবি: পেক্সেলস

নসিহত শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো: খাঁটি সদিচ্ছা, আন্তরিক উপদেশ, কল্যাণকামিতা এবং সংশোধনে সাহায্য করা।

সংক্ষেপে নসিহত মানে:

  • আন্তরিকভাবে কারও ভালো চাওয়া।

  • তার ভুল থেকে ফিরিয়ে সৎ পথে পরিচালিত করা।

  • পক্ষপাতহীন, পরিষ্কার ও সত্যিকারের খেয়াল রাখা।

কেউ কোনো ভুল করলে কঠোর না হয়ে কোমলভাবে তার ভুল সংশোধন করাটাই নসিহত। আবার কাউকে কোনো বিষয় শেখানোর উদ্দেশ্যে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করাও নসিহতের অন্তর্ভুক্ত।

নসিহত এবং তিরস্কার: বিপরীতধর্মী দুটি বিষয়

দুঃখজনক বিষয় হলো অনেকেই নসিহত করতে গিয়ে অজান্তে তিরস্কার করে ফেলে। তখন বলে, ‘আমি তো ভালোর জন্যই বলি।’ অথচ নসিহত আর তিরস্কার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বিষয়।

তিরস্কার শব্দের অর্থ হলো—ধমক, ভর্ৎসনা, ভুলের জন্য কঠোরভাবে সতর্ক করা বা অসন্তোষ প্রকাশ করা।

সংক্ষেপে তিরস্কার মানে:

  • কোনো ভুল বা অনুচিত কাজের কারণে কাউকে কঠিন ভাষায় সতর্ক করা।

  • অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে ভুল থেকে ফিরিয়ে আনতে তাগিদ দেওয়া।

আরও পড়ুন
নসিহত প্রদানকারী চায়, তার ভাইয়ের সংশোধন হোক, তার ভুল দূর হোক এবং আল্লাহ তার জন্য কল্যাণ লিখে দিন। আর তিরস্কারকারী চায়, তার ভুল প্রকাশ পাক, তাকে লজ্জায় ফেলা যাক।
ইবনুল কাইয়িম জাওযি (রহ.)

নসিহত করতে গিয়ে তিরস্কার করে ফেললে হিতে বিপরীত হয়। উপকার করতে গিয়ে ক্ষতি হয়, সম্পর্কের উন্নতির জায়গায় অবনতি ঘটে। তাই নসিহত ও তিরস্কার সম্পর্কে জ্ঞান রাখা জরুরি।

নসিহতের মর্ম: গোপনীয়তা ও কল্যাণ

নসিহত সাধারণত গোপনে করা উত্তম। এতে লক্ষ্য থাকে—উপদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি লজ্জিত না হয়ে যেন নিজের ভুল সংশোধন করতে পারে।

তবে কখনো এমনও হয় যে ব্যক্তি নিজের ভুল বুঝতে পারে না বা বারবার বলা সত্ত্বেও সংশোধন করতে চায় না। তখন প্রয়োজন হতে পারে আন্তরিক ও বিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে তার কাছে নসিহত পৌঁছে দেওয়া। কারণ, অনুপযুক্ত ব্যক্তি নসিহত দিলে উপকারের বদলে ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে।

অনেকেই নসিহত দেওয়ার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করে। তাদের কাছে নিজের পছন্দের মানুষের ভুল সব সময় স্বাভাবিক মনে হয়, আর অন্যদের সামান্য ভুলও বড় হয়ে দেখা দেয়। নসিহতের নামে তারা তিরস্কার করে, ব্যক্তির সম্মান নষ্ট করে এবং কষ্ট দেয়। অথচ নসিহতের মূল উদ্দেশ্য হলো কল্যাণ কামনা করা এবং ভুল সংশোধন করা।

ইবনুল কাইয়িম (রহ.)-এর ব্যাখ্যা

ইবনুল কাইয়িম জাওযি (রহ.) নসিহত ও তিরস্কার নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন, যা উভয়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরে:

  • নসিহত হলো গোপনে উপদেশ দেওয়া। যারা লোকদেখানো ইবাদত করে (রিয়াকার), তাদের নসিহত হয় প্রকাশ্যে।

  • নসিহত প্রদানকারী চায়, তার ভাইয়ের সংশোধন হোক, তার ভুল দূর হোক এবং আল্লাহ তার জন্য কল্যাণ লিখে দিন। আর তিরস্কারকারী চায়, তার ভুল প্রকাশ পাক, তাকে লজ্জায় ফেলা যাক।

  • তাই নসিহত আসে দয়া ও কোমলতা থেকে; আর তিরস্কার আসে ক্রোধ ও অপমানের বাসনা থেকে।

  • নসিহত প্রদানকারী যেন একজন চিকিৎসকের মতো—রোগীকে কষ্ট না দিয়ে ওষুধ দেয়, ধৈর্য নিয়ে ক্ষত সারায়, যাতে সে সুস্থ হয়। আর তিরস্কারকারী যেন সেই ব্যক্তির মতো—যে রোগীর ক্ষতস্থানে বারবার আঘাত করে, দাগকে বাড়িয়ে দেয় এবং রোগ আরও গভীর করে ফেলে।

  • নসিহত মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে; আর তিরস্কার মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।’ (আল-ফাওয়াইদ, পৃষ্ঠা: ৭৫-৭৮)

আরও পড়ুন
মানুষের সত্যিকার কল্যাণ কামনা করে তার ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে উপদেশ দেওয়াই নসিহতর প্রকৃত রূপ। আর এটি মানুষের মনোজগৎ উন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হয়।

হাদিসে নসিহত

রাসুল (সা.) কাউকে ব্যক্তিগতভাবে লজ্জা দিতেন না। কেউ ভুল করলে তিনি এভাবে পরোক্ষভাবে বলতেন, ‘লোকদের কী হলো যে তারা এমন কাজ করছে?’

অর্থাৎ, তিনি ব্যক্তি নয়, বরং কাজকেই লক্ষ্য করে বলতেন। এই পদ্ধতি আমাদের শেখায়—নসিহত কখনোই তিরস্কার বা অপমানের মাধ্যমে হওয়া উচিত নয়।

এ ছাড়া নসিহত সম্পর্কে একটি চমৎকার উপমা রয়েছে, একজন মুমিন অন্য মুমিনের জন্য আয়নার মতো, যার মাধ্যমে সে নিজের দোষত্রুটি ও ভালো দিকগুলো দেখতে পায় এবং নিজেকে সংশোধন করতে পারে।

অর্থাৎ, মুমিন ভাই যখন আপনার কোনো ভুল দেখে, সে আপনাকে সেই ভুল এমনভাবে দেখায়—যেমন আয়না নিঃশব্দে সত্য দেখিয়ে দেয়, কোনো অপমান করে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেমন একজন মানুষ নিজেকে সুন্দর করে তোলে, তেমনি মুমিন তার ভাইয়ের মধ্যে নিজের ভুলগুলো দেখতে পায় এবং নিজেকে শুধরে নিতে পারে।

শেষ কথা

নসিহত হলো আন্তরিকতা, কোমলতা এবং মানুষের কল্যাণ কামনার প্রতীক। মানুষের সত্যিকার কল্যাণ কামনা করে তার ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে উপদেশ দেওয়াই নসিহতর প্রকৃত রূপ। আর এটি মানুষের মনোজগৎ উন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হয়।

তাই আমাদের উচিত, নসিহতকে প্রকৃত নসিহত হিসেবে রাখা। নসিহতকে তিরস্কার ও অপমানের মাধ্যম বানানো নয়।

[email protected] 

ইসমত আরা : শিক্ষক, লেখক

আরও পড়ুন