‘তুমি পর্বতমালাকে দেখছ, ভাবছ সেগুলো অচল’

পবিত্র কোরআনে এমন কিছু মহাজাগতিক আয়াত রয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে তাফসিরকারক ও আধুনিক বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছে।

এমনই একটি আয়াত হলো সুরা নামলের ৮৮ নম্বর আয়াত, “আর তুমি পর্বতমালাকে দেখছ, তুমি সেগুলোকে অচল মনে করছ, অথচ সেগুলো মেঘের মতো চলমান। এটা আল্লাহরই কৌশল, যিনি সবকিছু নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত।” (সুরা নামল, আয়াত: ৮৮)

এই আয়াতে বর্ণিত পর্বত বা পাহাড়ের আপাত স্থিরতা ও অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা সম্পর্কে তাফসিরকারক ও আধুনিক গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এই মতভেদ মূলত এর প্রেক্ষাপট নিয়ে—এটি কি কিয়ামতের দৃশ্য, নাকি দুনিয়ার চলমান বাস্তবতা?

আর তুমি পর্বতমালাকে দেখছ, তুমি সেগুলোকে অচল মনে করছ, অথচ সেগুলো মেঘের মতো চলমান। এটা আল্লাহরই কৌশল, যিনি সবকিছু নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন।
কোরআন, সুরা নামল, আয়াত: ৮৮

ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যা: কিয়ামতের মহাপ্রলয়

প্রাথমিক যুগের তাফসিরকারকগণ এই আয়াতটিকে কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের দৃশ্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে, আয়াতের পূর্বাপর ধারাবাহিকতা এই ধারণাকে সমর্থন করে।

এই আয়াতের ঠিক আগের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে বলেন, “আর যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, সেদিন আল্লাহ যাদের চান তারা ছাড়া আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে এবং সবাই তাঁর কাছে বিনীতভাবে উপস্থিত হবে।” (সুরা নামল, আয়াত: ৮৭)

তাঁদের যুক্তি হলো, কিয়ামতের বর্ণনার পরপরই পর্বতমালাকে মেঘের মতো চলমান হিসেবে উল্লেখ করা মানে এটি সেই দিনের দৃশ্য।

ইবনে কাসির (মৃ. ৭৭৪ হি.) বলেন, মানুষ পর্বতকে স্থির ও অপরিবর্তিত মনে করবে, অথচ সেগুলো মেঘের মতো দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে সরে যাবে।

তিনি এই প্রসঙ্গে কেয়ামত বিষয়ক অন্যান্য আয়াত উল্লেখ করেন, যেমন:

“যেদিন আকাশমণ্ডল দুলতে থাকবে প্রবলভাবে, এবং পর্বতমালা চলতে থাকবে দ্রুতগতিতে।” (সুরা তুর, আয়াত: ৯-১০),

“আর তারা তোমাকে পর্বতমালা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। সুতরাং তুমি বলো, আমার প্রতিপালক সেগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে উড়িয়ে দেবেন, অতঃপর তিনি সেগুলোকে মসৃণ সমতলভূমি করে দেবেন। তুমি তাতে কোনো বক্রতা ও উচ্চতা দেখবে না” (সুরা ত্বাহা, আয়াত: ১০৫-১০৭) (তাফসিরুল কোরআনিল আযিম, ৬/২০৪, দার তাইয়্যেবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)

ঐতিহ্যবাহী তাফসির মতে, কিয়ামতের দিন যখন মহাজাগতিক শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে, তখন পর্বতমালাও নিজ স্থান থেকে সরে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে—সেই দৃশ্যকেই চলমান মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

আধুনিক ব্যাখ্যা: পৃথিবীর ঘূর্ণন ও বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত

আধুনিক তাফসিরকারক ও কোরআনের বৈজ্ঞানিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করেন এমন অনেকেই এই আয়াতটিকে দুনিয়ার চলমান দৃশ্য-এর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, এটি একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক সত্যের ইঙ্গিত, যা পূর্বে অজানা ছিল—পৃথিবীর ঘূর্ণন ও গতিশীলতা।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, যারা পর্বতমালাকে দেখেন, প্রথম দৃষ্টিতে তারা সেগুলোকে স্থির মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পর্বতগুলো পৃথিবীর অংশ হিসেবেই মেঘের গতির মতো চলমান। এই গতি মূলত পৃথিবীর ঘূর্ণনজনিত গতি, যা পর্বতগুলোকে বহন করে চলেছে। যদিও একজন পর্যবেক্ষক পর্বতকে স্থির দেখে, কিন্তু তারা মেঘের মতো গতিশীল—যা আসলে পৃথিবীর গতি।

ঐতিহ্যবাহী তাফসির মতে, কিয়ামতের দিন যখন মহাজাগতিক শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে, তখন পর্বতমালাও নিজ স্থান থেকে সরে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে—সেই দৃশ্যকেই চলমান মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

ইবনে আশুরের দৃষ্টিভঙ্গি

আধুনিক ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে ইবনে আশুরের (মৃ. ১৩৯৩ হি.) ব্যাখ্যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রাচীন তাফসিরকারকদের মতামতের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তিনি মনে করেন, কিয়ামতের দৃশ্যের সঙ্গে উপমা, বিশেষণের ব্যবহার এবং আয়াতের শেষাংশ অর্থাৎ “এটা আল্লাহরই কৌশল, যিনি সবকিছু নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন” বাক্যটি সংগতিপূর্ণ নয়।

তিনি শক্তিশালীভাবে এই মতকে সমর্থন করেন যে, এটি দুনিয়ার দৃশ্যের বর্ণনা এবং পৃথিবীর গতির প্রতি একটি ইঙ্গিত। তাঁর মতে, এটি কোরআনে নিহিত বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতাগুলোর মধ্যে অন্যতম (আত-তাহরির ওয়াত তানভির, ২০/ ৩২৩-৩২৪, দার সাহনুন, তিউনিস, ১৯৯৭)

অলঙ্কারিক সৌন্দর্য: মেঘের সঙ্গে গতির তুলনা

আধুনিক গবেষকদের মতে, পর্বতকে মেঘের গতিরসঙ্গে তুলনা করার বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে:

স্বাভাবিক গতি নয়: মেঘ যেমন নিজ থেকে চলে না, বরং বাতাসের মাধ্যমে বাহিত হয়, তেমনি পর্বতও নিজ থেকে চলে না, বরং পৃথিবীর গতি দ্বারা বাহিত হয়। এই তুলনাটি অত্যন্ত গভীর এবং পৃথিবীর গতিশীলতার প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেয়। পর্বত তার বাহক (পৃথিবী) দ্বারা বাহিত হয়ে মেঘের মতো গতিশীল।

আপাত স্থিরতা: কোরআন এমন এক শৈলী ব্যবহার করেছে যা সাধারণ মানুষের পৃথিবী স্থির থাকার অনুভূতিকে ধাক্কা দেয় না, কিন্তু একই সঙ্গে মহাজাগতিক সত্যকেও অস্বীকার করে না। মানুষ স্থির দেখে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

আরও পড়ুন

ভাষাগত ও যৌক্তিক সমর্থন

আধুনিক ব্যাখ্যার সমর্থনে ভাষাগত ও যৌক্তিক দিক থেকেও বেশ কিছু যুক্তি পাওয়া যায়:

প্রেক্ষাপটের পুনরাবৃত্তি: যদিও আয়াতটি কেয়ামত সম্পর্কিত আয়াতের পর এসেছে, কিন্তু কোরআনে প্রায়ই দেখা যায় যে, একটি মহাজাগতিক সত্যকে উল্লেখ করা হয়, যা আল্লাহর ক্ষমতা ও সৃষ্টির নিখুঁততার প্রমাণ হিসেবে কিয়ামতের দৃশ্যকে নিশ্চিত করে।

যেমন সুরা আরাফের ৫৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বৃষ্টি ও মৃত জমিন থেকে ফসল সৃষ্টির কথা উল্লেখ করার পর বলেন, “এভাবেই আমরা মৃতদেরকে বের করে আনব, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।”

এখানেও একটি দৃশ্যমান মহাজাগতিক ঘটনাকে (বৃষ্টি ও ফসল) অদৃশ্য বা অদেখা সত্য (মৃত্যুর পর পুনরুত্থান) প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

আবার সুরা নামলের ৮৮ নম্বর আয়াতের আগে দিন-রাতের পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, “তারা কি দেখেনি যে, আমি রাত সৃষ্টি করেছি যাতে তারা বিশ্রাম করতে পারে এবং দিনকে করেছি আলোকোজ্জ্বল? নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে সেই কওমের জন্য যারা ইমান আনে।”

দিন-রাত (দুটি মহাজাগতিক দৃশ্য) এবং পর্বতের গতির (আরেকটি মহাজাগতিক দৃশ্য) মধ্যে শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়ার আয়াতটি একটি সংযোগস্থাপনকারী বিরতি হিসেবে এসেছে।

পর্বতগুলো পৃথিবীর অংশ হিসেবেই মেঘের গতির মতো চলমান। এই গতি মূলত পৃথিবীর ঘূর্ণনজনিত গতি, যা পর্বতগুলোকে বহন করে চলেছে।

শব্দের তাৎপর্য

‘তুমি দেখছ’: এখানে বর্তমান কালের ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে, যা ঘটমানতা ও নবায়নকে বোঝায়। এর অর্থ এমন দেখা যা গভীর চিন্তা ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে উপলব্ধি করা যায়।

‘মনে করছ’: এই শব্দটি ধারণা বা অনুমানকে বোঝায়, যা বাস্তবতার বিপরীত হতে পারে। কিয়ামতের দৃশ্য তো চূড়ান্ত সত্য, সেখানে অনুমানের অবকাশ নেই। পাহাড় যখন ধ্বংস হবে, তখন এটি স্পষ্ট সত্য হবে, অনুমান নয়। কিন্তু দুনিয়ায় পাহাড়কে স্থির মনে করা হয় (অনুমান), যখন তার বাস্তব সত্য হলো সে গতিশীল।

‘নিখুঁত সৃষ্টি’: আয়াতের শেষাংশ “এটা আল্লাহরই কৌশল, যিনি সবকিছু নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন” মহাজাগতিক সৃষ্টি ও তার শৃঙ্খলার সঙ্গে বেশি মানানসই। কিয়ামতের দৃশ্য, যেখানে সবকিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ধ্বংসের পথে, সেখানে 'নিখুঁত সৃষ্টি'র বর্ণনা ততটা সংগতিপূর্ণ নয়, যতটা চলমান ও সুশৃঙ্খল পৃথিবীর গতির বর্ণনার সঙ্গে।

কোরআনের আয়াতটি উভয় ক্ষেত্রেই প্রজ্ঞা বহন করে। ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যা কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দেয়, আর আধুনিক ব্যাখ্যা পৃথিবীর ঘূর্ণন ও মহাজাগতিক গতির প্রতি ইঙ্গিত করে। তবে ভাষাগত ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের গভীরতা আধুনিক ব্যাখ্যার দিকেই বেশি ঝুঁকছে।

আরও পড়ুন