মদিনায় জিয়ারা, যুলহুলাইফায় ইহরাম বাঁধা

মদিনায় অবস্থানকালে সবাই জিয়ারত যায় মানে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখে। মসজিদে নববীর দক্ষিণ দিকে আবু আইয়ুব আল-আনসারী সড়কের সামনে গাড়ির চালকেরা ফজরের নামাজের পর থেকেই ডাকেন ’জিয়ারা, জিয়ারা।’ একটু দমদার করে উঠতে হয়। আমরা কয়েকজন একদিন ফজরের সালাতের পর ওখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করি। চালক পাকিস্তানি।

আরেকদিন আমাদের হোটেলের সামনে থেকে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক বাংলাদেশি ছাত্র জিয়ারত নিয়ে যান। ছাত্রটি পড়ালেখার ফাঁকে নিজের গাড়িতে হাজিদের জিয়ারা করিয়ে কিছু হাতখরচ জোগাড় করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করার এই পরিশ্রম কষ্টসাধ্যও বটে।

দুই দিনের জিয়ারত আমরা ওহোদ যুদ্ধের ময়দান, মসজিদে কুবা, মসজিদে কিবলাতাইন, খন্দক যুদ্ধের প্রান্তর, বিরয়ে শিফা, সালমান ফারসির খেজুর বাগান, বাদশা ফাহাদ কোরআন ছাপাখানা এবং মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি। আমি ও আমরা সহধর্মিণী, শাহাদাত ভাই ও তাঁর সহধর্মিণী, এবং তানজীর, তাঁর সহধর্মিণী এবং তাঁর মা—এই সাতজন মিলে জিয়ারত গিয়েছিলাম।

আরও পড়ুন

উহুদ প্রান্তরে ৭০জন শহীদের কবর রয়েছে। এখানে মক্কার কাফেরদের সঙ্গে রাসুল (সা)-এর নেতৃত্বে মদিনার মুসলমানদের দ্বিতীয় যুদ্ধটি হয়েছিল। এখানে শহীদদের কবর জিয়ারত ছাড়া অন্য কোনো কিছু না করার জন্য যে নির্দেশনা টাঙানো রয়েছে, তার একটি বাংলা ভাষায়। দেখে ভালো লাগল।

কুবা মসজিদে গিয়ে আমরা দুরাকাত নফল নামাজ আদায় করলাম। রাসুল (সা.) মদীনায় হিজরত করে প্রথমে কুবা এলাকায় কুলুসম ইবনে হিদমের বাড়িতে ওঠেন। এখানেই তিনি মদিনার প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। আর কিবলাতাইন মসজিদটি সেই স্থান যেখানে মুসলমানদের কিবলা জেরুজালেমের বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ঘুরে মক্কার কাবাশরিফের দিকে নির্ধারণে আল্লাহর ওহি এসেছিল। তখন জোহরের ফরজ সালাতের দু রাকাত সম্পন্ন হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.) উত্তর থেকে মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণে মুখ করে বাকি দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন।

সালমান ফারসির খেজুর বাগানও এক ঐতিহাসিক স্থান। এখানে রাসুল (সা.) নিজ হাতে অনেকগুলো খেজুর গাছ লাগিয়েছিলেন। বাগানের পুরো এলাকায় একটা ঠান্ডা ভাব অনুভূত হয়।

বাদশাহ ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং প্রেস পরিদর্শন শেষে আমাদের বাংলা তরজমা ও তফসিরসহ এক সেট করে কোরআন হাদিয়া হিসেবে দেয়া হয়। এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কোরআন ছাপাখানা।

মদিনা থেকে প্রায় সবাই বেশ কিছু কেনাকাটা করেছেন, বিশেষত খেজুর। মক্কার মতো এখানেও প্রচুর বাংলাদেশি আছেন। ফলে পথেঘাটে কোথাও কোনো সমস্যা হয় না।

আরও পড়ুন

দুই.

২২ জুন বৃহস্পতিবার মাঝরাতের বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা বাসে চেপে মক্কার উদ্দেশে রওনা দেই ইহরামের লেবাস পরিধান করে। মসজিদে নববি থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে যুলহুলাইফা মিকাতে এসে বাস থামে। আরও অনেক বাস এসেছে। হাজার হাজার হাজি এখানে ইহরাম বাঁধবেন মানে ওমরাহর নিয়তে। আমরাও নেমে গেলাম। যাদের প্রয়োজন ছিল টয়লেট সেরে অজু করে নিলেন। ফজরের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় আমরা ওখানেই ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম।

এই মিকাতে আমি ও আমার সহধর্মিণী যার যার মরহুম বাবার বদলি ওমরাহর নিয়ত করলাম। কারণ, আমরা তামাত্তু হজযাত্রী। আর সেদিন ছিল ১৪৪৪ হিজরির ৪ জিলহজ। আরও তিন দিন পরে মক্কায় আমাদের আবাসস্থল থেকে হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধব। অবশ্য অল্প কয়েকজন কিরান হজযাত্রীর মতো একবারে হজ ও ওমরাহ করার নিয়ত করলেন। ফলে তাঁরা মক্কায় গিয়ে ওমরাহ সম্পন্ন করেও শুধু চুল না কেটে ইহরাম অবস্থায় থেকে যাবেন একেবারে হজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

বাস আবার চলতে শুরু করল। সাধারণত মদিনা থেকে মক্কা আসতে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। কিন্তু হজের সময় যত ঘনিয়ে আসে, সময় তত বেশি লাগে বিশেষত মক্কায় প্রবেশের জন্য। মদিনা থেকেই শত শত বাস আসছিল। আবার জেদ্দা থেকেও বিভিন্ন দেশের শেষ ফ্লাইটের হাজিরা আসছিলেন। ফলে মক্কার সীমানার কাছে এসে বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো দফায় দফায় বাসের কাগজপত্র পরীক্ষার জন্য। এতে করে যখন মক্কায় প্রবেশ করলাম তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। একটা জায়গায় পুলিশ বাস আটকে দিল। হজযাত্রীদের নামারও অনুমতি দিল না। ফলে জুমার নামাজ আদায় করতে পারলাম না আমরা। হারামে জুমা শেষ হওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে বাস ছাড়া পেল। আর তাই হোটেলে এসে পৌঁছলাম প্রায় আড়াইটার দিকে। হোটেলেই দ্রুত জোহরের ফরজ নামাজ আদায় করে নিলাম। আর ওমরাহ সম্পন্ন করলাম ইশার নামাজের পর।

আরও পড়ুন

তিন.

গাইড আক্তার ভাইর এই দলের বেশির ভাগ হজযাত্রী আমরা হোটেলের নবম তলায় ছিলাম। লিফটের নবম, আসলে ১১ তলা। বাকিরা ১০ম ও ১২দশ তলায়। নবম তলায় রাজউকের অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নজরুল আলম ভাইকে ঘিরে আমরা কয়েকজন মাঝে-মধ্যে আলাপচারিতার আসরে বসতাম যেখানে মূলত হজের ব্যবস্থাপনা, আমাদের প্রস্তুতি ইত্যাদি নিয়ে কথা হতো। দু–চারটা হাসিঠাট্টা যে হতো না, তাও নয়। বরং কখনো একটু বেশিই হতো। নজরুল ভাইর কক্ষে ছিলেন হাফেজ সাব্বির ভাই ও ব্যবসায়ী ইকবাল মহিউদ্দিন। আরও ছিলেন মাশরুর ভাই যাকে নজরুল ভাই ডাকতেন ‘আশেকে রাসুল’ বলে। কেননা, প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নাহ পালনের ক্ষেত্রে তিনি বলতে গেলে অনেকের চেয়ে বেশি সচেষ্ট থাকতেন।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।

আরও পড়ুন