আমার রব আমাকে ছেড়ে যাবেন না

জীবনে চলার পথে আমরা প্রায়ই এমন ঘটনার মুখোমুখি হই

মানুষ যত দিন বেঁচে থাকে, তত দিন জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্ন কখনো বাস্তব, কখনো অবাস্তব। আল্লাহ যে তকদির ঠিক করে রেখেছেন, সেটা মানুষের অজানা। তাই সে ইচ্ছেমতো ভাবে, স্বপ্ন দেখে। আর যখন যে অবশ্যম্ভাবী তকদির এসে সামনে দাঁড়ায়, অপ্রত্যাশিত আঘাত কিংবা আনন্দ দিয়ে, মানুষ বিহ্বল হয়ে পড়ে।

জীবনে চলার পথে আমরা প্রায়ই এমন ঘটনার মুখোমুখি হই। হয়তো ভাবি, কেন এভাবে একটা সাজানো সুন্দর ছিমছাম সংসারে মা কিংবা বাবাকে বিদায় নিতে হলো চিরতরে? পরিবারের বাকি মানুষগুলো এখন কী নিয়ে বাঁচবে?

আসলেই আল্লাহ কেন মানুষকে এ রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিয়ে যান, তার কারণ সব সময় আমাদের বোধগম্য হবে না। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আমরা কী করে নিজেদের আল্লাহর ওপর ভরসা, অর্থাৎ তাওয়াক্কুলের ওপর সুদৃঢ় রাখব? আসুন, দেখি, ইসলাম এ নিয়ে আমাদের কী শেখাতে চায়।

জীবনে চলার পথে আমরা প্রায়ই এমন ঘটনার মুখোমুখি হই। হয়তো ভাবি, কেন এভাবে একটা সাজানো সুন্দর ছিমছাম সংসারে মা কিংবা বাবাকে বিদায় নিতে হলো চিরতরে?
আরও পড়ুন

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর আদেশে ইব্রাহিম (আ.) হাজেরা ও তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইলকে নিয়ে নির্বাসন দানের জন্য বের হলেন। পথে হাজেরা শিশুকে দুধ পান করাতেন। তিনি তাদের উভয়কে মক্কার বিজনভূমে রেখে গেলেন। দিয়ে গেলেন একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে স্বল্প পরিমাণ পানি।

তারপর ইব্রাহিম (আ.) নিজ গৃহ অভিমুখে ফিরে চললেন। ইসমাইলের মা তার পিছু পিছু ছুটে এলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন, হে ইব্রাহিম, কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমাদের রেখে যাচ্ছেন এমন এক ময়দানে, যেখানে না আছে কোনো সাহায্যকারী, না আছে পানাহারের কোনো বস্তু। এর আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। হাজেরা বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদের ছেড়ে যাবেন না।

এই যে, ‘আমার রব আমাকে ছেড়ে যাবেন না’, এটা হলো আল্লাহর ওপর ভরসা অর্থাৎ তাওয়াক্কুলের একটি রূপ। হাজেরা হয়তো যা ভেবেছিলেন, স্বামীর সঙ্গে একটা সুন্দর সংসার হবে, শিশুপুত্র সেখানেই বেড়ে উঠবে। তাঁর কোনো কল্পনাতেও হয়তো ছিল না যে এমন এক জায়গায় অল্প খাবার আর পানিসহ তাঁকে রেখে যাওয়া হবে। অন্যদিকে সেদিন যদি হাজেরা ধৈর্য ধারণ না করতেন, কান্নাকাটি করতেন বা অস্থির হয়ে ফেরত যেতে চাইতেন তাহলে এই যে এত বড় সভ্যতার সূচনা তাঁর মাধ্যমে হয়েছে, তার কিছুই হতো না।

আরও পড়ুন
হাজেরা হয়তো যা ভেবেছিলেন, স্বামীর সঙ্গে একটা সুন্দর সংসার হবে, শিশুপুত্র সেখানেই বেড়ে উঠবে। তাঁর কোনো কল্পনাতেও হয়তো ছিল না যে এমন এক জায়গায় অল্প খাবার আর পানিসহ তাঁকে রেখে যাওয়া হবে।

আজ পবিত্র কাবার চারপাশে যখন দিনের প্রতিটি সেকেন্ডে হাজার হাজার মানুষ তাওয়াফ করেন, সে কাবা তাঁর সন্তানের হাতে তৈরি হতো না। প্রতিদিন লাখো মানুষ তাঁর পেরেশানির অনুকরণে সাফা-মারওয়া সাঈ করেন, এমনকি এক জায়গায় এসে ঠিক হাজেরার অনুকরণে এদিক-ওদিক তাকান, দ্রুত পা ফেলেন, এত বড় মর্যাদার অধিকারীও তিনি হতেন না।

ইসলামের অন্যতম রুকন হয়েছে হজ। বছরে একবার ৩০ লাখেরও অধিক মানুষ হাজেরার অনুকরণে সাঈ করেন, আর সারা বছর উমরাহ করতে গিয়েও সাঈ করা অবশ্যকরণীয়। সারা পৃথিবীর মুসলিমেরা সেই জমজম কূপের পানিতে শেফা খোঁজেন, যার শুরু হয়েছিল হাজেরার পুত্র ইসমাইলের পদভারে।

মক্কার সুবিশাল এই সভ্যতা, এই ইবাদতের সংস্কৃতি, এর মূলে কোটি মুসলিমের হৃদয়ে পুনরুজ্জীবিত হয় হাজেরার সেই ভরসার উচ্চারণ, ‘আমার রব আমাকে ছেড়ে যাবেন না’। ক্ষণিকের স্বপ্ন ভেঙে গেলে যখন আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ি, এই তাওয়াক্কুলই আমাদের আবার ধীরস্থির হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক, প্রকৌশলী

[email protected]

আরও পড়ুন