মিনা ছেড়ে জামারায়, সামীর কান্না

জামারা,মিনা, মক্কাছবি: ফেরদৌস ফয়সাল

জুম্মার সালাতের একটু পরই খাবার চলে এল। উটের গোশত দিয়ে বিরিয়ানি। চেটেপুটে পুরো বাক্সটাই সাবাড় করলাম আমি। বাকিদেরও কমবেশি একই অবস্থা। কয়েক বাক্স খাবার পরেই রইল। কেউ কেউ বাড়তি একটা বাক্স নিয়ে দুতিনজন মিলে ভাগ করে আরেকটু খেলো মজাদার এই খাবার। আসলে হজের ফরজ আদায় সব হয়ে গেছে। তৃতীয় দিনের কঙ্কর নিক্ষেপ ছাড়া আর সব ওয়াজিব আদায়ও শেষ। সবার শরীর ও মন ফুরফুরে হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।

ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে আমরা মিনার তাঁবু ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলাম। নজরুল ভাই, সাব্বির ভাই, ইকবাল, সানোয়ার, সামী, শাহাদাত ভাই ও তাঁর সহধর্মিণী, আমি ও আমার সহধর্মিণী। আমাদের একটু আগে হামিদ ভাই, সাইফুল ভাই, মিন্টু ভাই, মাহমুদ বেগ ও তাঁদের সহধর্মিণীরা রওনা হয়ে গেছেন জামারার পথে। পেডেস্ট্রিয়ান রোড বা টিনশেডের পথ ধরে তখন হাজার হাজার হাজি জামারা অভিমুখে যাচ্ছেন। আমরাও তাদের মিছিলে শরিক হয়ে গেলাম। যথারীতি দুপাশে ফোয়ারা থেকে পানি ছিটানো হচ্ছে। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরাও হাজিদের চোখেমুখে পানি স্প্রে করার পাশাপাশি ‘হজে মাবরুর’ বলে বিদায় জানাচ্ছে। কেউ কেউ আরবি ও ইংরেজিতে বলছে ‘ভবিষ্যতে আবার দেখা হবে’। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, আবেগঘন সময়।

দেখতে দেখতে জামারার কাছে চলে এলাম আমরা। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে হাজিরা জামারায় তৃতীয় দিনের কঙ্কর নিক্ষেপ করছেন।এদিন মানে ১২ জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করে প্রায় সব হাজি মক্কায় চলে যান। সে জন্য সূর্য ডোবার আগে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়। না হলে ওই রাতেও মিনায় থাকতে হবে। অবশ্য অল্প কয়েকজন হাজি স্বেচ্ছায় আরও এক রাত মিনায় থেকে পরের দিন মানে ১৩ জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করে তারপর মক্কায় ফেরত আসেন। আমাদের দলের মাশরুর তাই করেছিলেন। সেটা আরেক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

পুলিশ আমাদের দোতলার পথে তুলে দিল। ছোট ও মধ্য জামারার কাছে গিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করা এবং তারপর কেবলামুখী হয়ে দুহাত তুলে দোয়া করা সুন্নাহ। কিন্তু অনেকেই দূর থেকে পাথর ছুড়তে শুরু করেন। ছোট জামারায় কঙ্কর সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করে একটু সামনে গিয়ে দোয়া করলাম। তারপর মধ্য জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখি একদল আফ্রিকার হাজি আসছেন পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে। দুতিনটা আমার মাথা ও চশমায় লাগল। মাথায় টুপি থাকায় চোট লাগেনি। আর চশমার পাশ ঘেষে যাওয়ায় কাচ ভাঙেনি। আমি দুহাত দিয়ে চোখমুখ ঢেকে দ্রুত পায়ে সরে গেলাম। এ কি কাণ্ড! এ যেন উন্মাদনা। কোথায় শয়তানকে পাথর মারতে এসেছে। না। উল্টো শয়তানই যেন কারও কারও ওপর চেপে বসেছে। আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাযিম।

আসলে এ তিনটি জামারা শয়তানের কোনো প্রতীক নয়। বরং এখানে পাথর নিক্ষেপ হলো হজরত ইব্রাহিম (আ.)-য়ের অনুসরণ । তিনি পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর নির্দেশে কোরবানি করার জন্য যখন মিনার দিকে নিয়ে আসছিলেন তখন শয়তান তাঁকে তিনবার ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি তিনবারই পাথর নিক্ষেপ করে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। হাজিরা সেটার অনুসরণেই পাথর নিক্ষেপ করেন। কেননা রাসুল (সা.) এভাবেই করেছেন ও করতে বলেছেন। হাজিদের সেটাই করতে হবে। ব্যস। কোনো যুক্তি খোঁজা বা শয়তানকে জামারায় বেঁধে রাখা হয়েছে মনে করার দরকার নেই।

বস্তুত পুরো হজই হলো হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত ইবাদত। তিনিই মুসলিম মিল্লাতের পিতা যিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। কোরআন শরিফে তাই রাসুল (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ‘এখন আমি তোমার ওপর প্রত্যাদেশ করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করো। ইব্রাহিম শরিককারীদের মধ্যে ছিলেন না।’ (১৬: ১২৩) হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর বড় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কাবাঘরকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। আবার আল্লাহর নির্দেশে তিনি সকল মুসলমানকে হজ করতে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

দুই

মধ্য জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ শেষ করে যখন বড় জামারার দিকে এগিয়ে গেলাম, তখন কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে শেষ পাথরটি নিক্ষেপের পর গলার ভেতর কেমন লাগছিল। আমরা দুজন দ্রুত সামনে এগিয়ে গেলাম। বড় জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর হাত তুলে দোয়া না করলেও হয়, কেননা রাসুল (সা.) করেননি।

খানিকটা এগিয়ে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাস্তার ঢালে। দুজন পুলিশ ওখানে ছিল।ভেবেছিলাম, দাঁড়াতে দেবে না। তবে তারা কিছু বলল না। পুব দিক ঘুরে তাকিয়ে দেখছিলাম অন্যদের যারা কঙ্কর নিক্ষেপ করছেন ও এগিয়ে যাচ্ছেন। চোখে পড়ল, আমাদের দলের অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য সামী বড় জামারা থেকে সামনে এগিয়ে এসে কিছুটা উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক হাঁটছে। ওর দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। নিজের আবেগকে নিজে সংযত করার চেষ্টা করছে। আমি ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম। আমার সহধর্মিণী বাধা দিয়ে বললেন, ‘ডেকো না।’ আর যেটুকু মুখে উচ্চারণ করে বললেন না, তা হলো, ‘ ওকে ওর একান্ত অনুভূতিটা অনুভব করতে দাও, ওর আবেগকে ওর মতো বইতে দাও।’

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন