রাসুল (সা.)-এর স্মৃতি–জড়িত সোনার মদিনায়

মক্কায় পৌঁছার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে মদিনায় যাই। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের আগে মদিনা সফরের ক্ষেত্রে মক্কার হোটেলে বড় লাগেজ রেখে যাওয়া যায়। শুধু আট দিনের প্রয়োজনীয় কাপড়, ওষুধপত্র ও আনুষঙ্গিক জিনিস এবং ইহরামের লেবাস সঙ্গে নিতে হয়।

আমরা মদিনা গিয়েছিলাম ১৪ জুন। ওই দিন বিকেলে বাসে চেপে আমরা রওনা হই। মাঝপথে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করি এবং রাতের খাবার সারি। তবে মদিনায় গিয়ে পরদিনই আমি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ভুগেছি। তাতে ১৬ জুন জুমার নামাজ আদায় করতে পারিনি। আল্লাহর রহমতে ওষুধ-পথ্য খেয়ে সেরে উঠতে থাকলে পরের কয়েক দিন মসজিদে নববিতে নামাজ আদায় করেছি। খালাম্মা মানে তানজীরের আম্মা আমার জন্য জাউ ভাত রান্না করে দিয়েছেন।

মদিনায় আমরা ছিলাম ওয়াফাদ আল জাহরা হোটেলে। এটা বাদশা ফয়সাল প্রথম রিং রোডের পুব দিকে দাঁড়ানো। আমরা এক কক্ষে ছিলাম ছয়জন যদিও এটা প্রকৃতপক্ষে তিনজনের জন্য বরাদ্দ। হজের মৌসুমে প্রায় সব হোটেলেই এ রকমটা হয় বিপুল সংখ্যক হাজির থাকার ব্যবস্থা করতে গিয়ে।

আরও পড়ুন

আমরা ছিলাম ছয়জন—শাহাদাত ভাই, ফখরুল ভাই, তানজীর, সানোয়ার হোসেন, সামিউল হাসান ও আমি। এদের মধ্যে বয়সে সবার বড় ফখরুল ভাই আগেও একবার হজ করেছেন। সৌদি আরবেই ছিলেন কয়েক বছর। অত্যন্ত কর্মঠ মানুষ। মানসিক জোরও ভীষণ। পিঠ ও কোমরের যন্ত্রণা নিয়ে তিনি বিমানে উঠেছিলেন। সানোয়ার ও সামী দুই তরুণ ব্যাংকার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায়ের জন্য যা যা করার সবই করেছে।

হোটেল থেকে প্রায় ২০ মিনিটের মতো পুব দিকে হাঁটলে মসজিদে নববি। মসজিদে নববি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ। এটা ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র। মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববি আর জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা- এই তিনটি মসজিদে সফর ও নামাজ আদায়ের জন্য রাসুল (সা.) উম্মতদেরকে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। দুনিয়ার আর কোনো মসজিদ এত মর্যাদাবান নয়।

মসজিদে নববি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই অন্যরকম একটা প্রশান্তি অনুভূত হয়। মসজিদের দক্ষিণদিকে সবুজ গম্বুজের নিচে রয়েছে রাসুল (সা.)-এর কবর বা রওজা মুবারক। তার পাশে প্রথমে হজরত আবু বকর (রা) এবং তারপর হজরত উমর (রা.)-এর কবর। যথেষ্ট নিরাপত্তাসহ সুন্দরভাবে কবরগুলো ঘিরে তৈরি হয়েছে সমাধি কক্ষ। এই কক্ষের চারদিকের সামনের অংশ স্বর্ণের তৈরি বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা এবং ক্যালিগ্রাফির লিপি ও নকশা দিয়ে সাজানো। মনে রাখা দরকার যে রাসুল (সা.)-কে তাঁর নিজ ঘরেই কবর দেওয়া হয়েছিল। তাই একে আল-হুজরা আল-নবুইয়াও বলা হয়। এই হুজরায় মা আয়েশা (রা) থাকতেন। সমাধি কক্ষের দক্ষিণ দিকের সম্মুখভাগটিতে স্বর্ণের গ্রিলের মাঝে ছয়টি গর্ত আছে যা দিয়ে ভেতরে থাকার তিনটি কবর দেখা যায়। তবে নিরাপত্তা প্রহরীরা যৌক্তিক কারণেই কাউকে অত কাছে ঘেঁষতে দেয় না। পশ্চিমদিকের বাবুস সালাম বা শান্তির দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে হুজুর (সা.) ও তাঁর দুই প্রধান সাহাবকে সালাম জানিয়ে পুব দিকের বাবুস বাকি বা বাকির দ্বার দিয়ে বেড় হয়ে যেতে হয়।

আরও পড়ুন

শাহাদাত ভাই মদিনায় অবস্থানকালীন আমাদের পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন যে প্রতিদিন মহব্বতের সঙ্গে কয়েক হাজারবার দরুদ শরিফ পড়তে। মদিনায় মসজিদে নববিতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর বসে প্রিয় নবী (সা.)-এর ওপর এভাবে সালাত ও সালাম পেশ করার যে অনুভূতি হবে, তা দুনিয়ায় আর কোথায় হবে না।

১৮ জুন মধ্যরাতে আমরা রিয়াদুল জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পেলাম। আমাদের গাইড আক্তার ভাই আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় অনুমতি বেড় করতে সক্ষম হন। দেড় বছর আগে ওমরার সময় এসে প্রথমবার রিয়াদুল জান্নাতে প্রবেশ করে নফল সালাত আদায় করেছিলাম। রাসুল (সা.) এর সমাধি কক্ষের পূ্র্ব দেয়াল থেকে শুরু করে পশ্চিমে অবস্থিত মিম্বর নববীর স্থানটুকু হলো রিয়াদুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান। শুধু এই জায়গাটুকু সবুজ গালিচায় মোড়ানো রয়েছে পৃথক করার জন্য।

একটা লক্ষণীয় দিক হলো মসজিদে নববিতে বিশেষত রাসুল (সা.)-এর কবর জিয়ারত ও রিয়াদুল জান্নাতের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা প্রায় সবাইই ধৈর্য ও বিনয় সহকারে হজযাত্রীদের সঙ্গে আচরণ করেন। বিপরীতে মক্কার দায়িত্বরত কর্মকর্তা থেকে প্রহরী সবার আচরণে রুক্ষতা বেশ স্পষ্ট।

আরও পড়ুন

মসজিদে নববির ১২ নম্বর ফটক দিয়ে প্রবেশ করে ছাদে উঠলে পাওয়া যাবে গ্রন্থাগারের মূল পাঠকক্ষ যা পুরুষদের জন্য। সুপ্রশস্ত এই গ্রন্থাগারের ব্যবস্থাপনাও চমৎকার। নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে প্রথমে আরবি ও তারপর ইংরেজিতে ঘোষণা ভেসে আসে যে সালাতের সময়ে কিছুক্ষণের জন্য গ্রন্থাগার বন্ধ থাকবে। এখান লাখখানেকের বেশি বই আছে। দুদিন আসরের ও মাগরিবের নামাজের পর এখানে কাটিয়েছিলাম। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষার বই পড়ার যোগ্যতা নেই, তারপরও। এখানে আরবি বইয়ের সংগ্রহটা সুবিশাল।

মসজিদে নববির পুব দিকের প্রাঙ্গণ পেরিয়ে রয়েয়ে বাকি কবরস্থান। এখানে শায়িত আছেন রাসুল (সা.)-এর সব সহধর্মিণী (খাদিজা ও মায়মুনা ছাড়া); কন্যা ফাতিমা, পুত্র ইব্রাহিম, এবং প্রায় দশ হাজার সাহাবা। একদিন ফজরের পর বাকির ভেতরে গিয়ে জিয়ারত করতে পেরেছিলাম।

মদিনাকে রুবি ফোনে যোগাযোগ করে আমরা সহধর্মিণীকে নিয়ে গেছে কয়েকবার। আমার জ্বর শুনে ফলমূল ও খাবার পাঠিয়েছে। এছাড়া একদিন মাগরিবের নামাজের পর ওদের চার তারকা হোটেলে নিয়ে রাতের খাবার খাইয়েছে। এ রকম মেহমানদারি পেতে কার না ভালো লাগে।

আরও পড়ুন