বাদশা নাজ্জাশির উদারতার কাহিনি
ইসলামের প্রথম যুগের কথা। ইথিওপিয়া ও তার আশপাশের কয়েকটি দেশ হাবশা বা আবিসিনিয়া নামে প্রসিদ্ধ ছিল। সে সময় আবিসিনিয়ার রাজা ছিলেন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী সম্রাট আসহামা ইবনে আবজার।
‘নাজ্জাশি’ ছিল আবিসিনিয়ার সম্রাটদের উপাধি। তিনি নবুওয়তের পঞ্চম বছরে মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলিমদের নিজ রাজ্যে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ দেন। তাঁর শাসনামলের প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে জানা যায়, ৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে আকসুম (বর্তমান ইথিওপিয়া) রাজ্যে তাঁর জন্ম। (এম এলফাসি ইভান হারবেক, আফ্রিকা ফ্রম দ্য সেভেনথ টু দ্য ইলেভেনথ সেঞ্চুরি, পৃষ্ঠা: ৫৬০)
‘নাজ্জাশি’ ছিল আবিসিনিয়ার সম্রাটদের উপাধি। তিনি নবুওয়তের পঞ্চম বছরে মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলিমদের নিজ রাজ্যে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ দেন।
পিতৃহত্যার গল্প
আসহামার পিতা আবজারের শাসনকালে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা ছিল। ইবনে হিশামের মতে, আসহামার বাবা বাদশাহ আবজার ছিলেন একজন জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ ও সাহসী ব্যক্তি। আসহামা তাঁর একমাত্র ছেলে। আবজারের ভাইয়ের ছিল ১২ ছেলে। সভাসদেরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করল। তারা সব প্রজাকে তাদের মিত্র করার কৌশল অবলম্বন করল।
তারা জনগণকে বলল, ‘যদি এই রাজার কিছু হয় এবং তার কিশোরপুত্র শাসক হয়, তাহলে সে একা কী করতে পারবে? এই রাজাকে সরিয়ে তাঁর ভাইকে রাজ্যাভিষেক করাই ভালো। কারণ, তাঁর ১২ জন ছেলে আছে। যারা তার শক্তির রহস্য এবং পরবর্তী সময়ে সরকারের শক্তির গ্যারান্টি হতে পারবে।’ একপর্যায়ে তারা আসহামার বাবাকে হত্যা করে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৩৮-৩৪০)
আসহামা তখন খুব ছোট। তার চাচা সিংহাসনে বসল। সভাসদেরা তাকে ভয় পেত, যদি ছেলেটি কখনো বড় হয়ে রাজা হয়, তাহলে সে অবশ্যই তার বাবার হত্যাকারীদের প্রতিশোধ নেবে। তাই তারা নতুন রাজাকে চাপ দিয়ে আসহামাকে ৬০০ দিরহামে বিক্রি করে দেয়। ক্রেতা বণিক তাকে নৌকায় করে তার স্বদেশে নিয়ে যায়।
সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ কালো ও ভয়ংকর মেঘ আকাশ ঢেকে ফেলে এবং বজ্রপাত পাহাড় কাঁপিয়ে তোলে। রাজা ভয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। বিদ্যুৎ চমকাল। দুষ্ট ষড়যন্ত্রকারীরা, রাজা এবং পুরোহিত মিলে রাজদরবারের মোট ২০ জনের সবাই সেই বিদ্যুতে অন্ধ হয়ে যান এবং পরে তাদের লজ্জাজনক মৃত্যু হয়। শেষে আসহামার হাতেই রাজ্যের শাসনভার ফিরে আসে। (সিরাতে হালবিয়া, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪৭৭-৪৮২; মাদারিজুন নবুওয়্যাহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২২০)
আসহামা তখন খুব ছোট। তার চাচা সিংহাসনে বসল। সভাসদেরা তাকে ভয় পেত যে, ছেলেটি বড় হয়ে কখনো রাজা হলে তার বাবার হত্যাকারীদের প্রতিশোধ নেবে।
শাসনকাল ও ব্যক্তিত্ব
তাঁর শাসনকাল ছিল ৬১৪ থেকে ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল মানবেতিহাসে বিরল। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা: ১১২; মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৪৩)
প্রাচীন ইথিওপিয়া বিশেষজ্ঞ স্টুয়ার্ট মুনরো-হে (১৯৪৭–২০০৪) উল্লেখ করেন, আসহামা হলেন আকসুমের সর্বশেষ রাজা; যিনি নিজ নামে মুদ্রা অঙ্কন করান। তাঁর শাসনামলের পাওয়া ব্রোঞ্জ মুদ্রাগুলোতে তার সিংহাসনে আসীন অবস্থায় পূর্ণাবয়ব দেখা যায়। মুদ্রাজুড়ে খ্রিষ্টান ক্রুশ মোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। (মার্কোভিটজ মাইক, দ্য কয়েনেজ অব আকসুম)
সাহাবিদের আশ্রয়দান
মক্কায় মুসলমানদের ওপর কুরাইশের নিপীড়ন বেড়ে গেলে মহানবী (সা.) সাহাবিদের পরামর্শ দেন আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে। তিনি বলেন, ‘সেখানকার খ্রিষ্টান বাদশাহ নাজাশি অত্যন্ত সৎ ও দরদি মানুষ। মানুষের প্রতি তিনি কখনো জুলুম করেন না।’
আমর বিন উমাইয়া জামরির হাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) আসহামার কাছে চিঠি পাঠান। তাতে লেখেন, ‘আমি আপনার কাছে আমার চাচাতো ভাই জাফরকে মুসলিমদের একটি দলসহ প্রেরণ করলাম। যখন তারা আপনার কাছে পৌঁছাবেন, তখন তাদের আপনার নিজের পাশে আশ্রয় দেবেন। কোনো প্রকার জোরজবরদস্তি অবলম্বন করবেন না।’ (জাদুল মাআদ, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৬২; সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩৫৯)
প্রথমে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী হিজরত করেন। ৬১৩-৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ১০১ জন নারী ও পুরুষ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এই মুহাজিরদের নেতৃত্ব দেন জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.)। আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর মাত্র ৪০ জন নারী-পুরুষ সে সময়ে মক্কায় রয়ে যান। ইসলামের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম হিজরত।
এই অনুসারীরা আশ্রয়ের জন্য আকসুম রাজ্যে পাড়ি জমান; যা ছিল একটি প্রাচীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র এবং বর্তমানের উত্তর ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। আনুমানিক ৬১৩ বা ৬১৫ সালে এই হিজরত অনুষ্ঠিত হয়। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৪৮)
কাফেরদের আবেদন প্রত্যাখ্যান
কুরাইশ নেতৃবৃন্দ দুজন কূটনীতিককে (আবু জেহেলের বৈপিত্রেয় ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আবি রাবিআ ও আমর ইবনুল আস) প্রচুর উপঢৌকনসহ বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে প্রেরণ করে। এই দুই কূটনীতিক প্রথমে নাজ্জাশির সভাসদদের প্রচুর উপঢৌকনের মাধ্যমে তাদের পক্ষে নেন; তারপর উপঢৌকনসহ উপস্থিত হয় নাজ্জাশির কাছে।
ঐতিহাসিকদের মাঝে তার মুসলিম হওয়া নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বিশুদ্ধ মত হলো, নাজ্জাশি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
সেখানে মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের ধর্মত্যাগী ও ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের ফেরত দানের আবেদন জানায়। সভাসদেরাও তাদের সঙ্গে একমত হয়ে ফেরত দানের জন্য বাদশাহর প্রতি অনুরোধ জানান। (নবিয়ে রহমত, পৃষ্ঠা: ১৪২)
তবে নাজ্জাশি মুসলিমদের ফেরত দিতে অস্বীকার করেন এবং নিরাপদে রাজ্যে বসবাসের সুযোগ করে দেন। কুরাইশ দূতরা লজ্জিত ও অপমানিত হয়ে মক্কায় ফিরে যায়। মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আরও পরে সপ্তম হিজরি পর্যন্ত মুহাজিররা সেখানে ছিলেন। এ কারণে ইসলামের ইতিহাসে তাঁকে ব্যাপক সম্মান দেওয়া হয়েছে। (উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট, মুহাম্মদ প্রফেট অ্যান্ড স্টেটসম্যান, পৃষ্ঠা: ৬৬)
মুসলিম হওয়ার প্রসঙ্গ
ঐতিহাসিকদের মাঝে তার মুসলিম হওয়া নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বিশুদ্ধ মত হলো, নাজ্জাশি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (ফাতহুল বারি, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ২২৮-২৩০)
তাবুকের যুদ্ধের পর ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে আনুমানিক ৭১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। (ই এ ওয়ালিস বাজ, আ হিস্ট্রি অব ইথিওপিয়া)।
তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) শোক প্রকাশ করেন, তাঁর জন্য দোয়া করেন এবং সাহাবিদের দোয়া করতে বলেন। (সিরাতে মোস্তফা, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৫১; আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা: ২০০)
মৃত্যুর দিনই মহানবী (সা.) সাহাবিদের তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে জানান। সবাইকে নিয়ে গায়েবানা জানাজা পড়েন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩২৭; মুসলিম, হাদিস: ৯৫১)