মহানবীর (সা.) চোখে দুনিয়া কেমন ছিল

দুনিয়া, এ এক বিচিত্র মোহের মায়াজাল। এখানে প্রতিনিয়ত মানুষ লিপ্ত থাকে খ্যাতি, সম্পদ আর ভোগবিলাসের পেছনে ছুটে চলার প্রতিযোগিতায়। আজকের উম্মাহর অধিকাংশ মানুষই দুনিয়ার মোহে বিভোর। কেউ ক্ষমতার চূড়ায় উঠতে চায়, কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর, আবার কেউ খ্যাতির দুনিয়ায় নিজেকে উঁচুতে তুলে ধরতে চায়।

রঙিন এই দুনিয়ায় যখন মানুষের অন্তর দুনিয়ার মোহে নিমজ্জিত, তখন যদি কোনো চিন্তাশীল হৃদয় নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘এই দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’

আমরা দেখি, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এ প্রশ্নের কী অপূর্ব উত্তর দিয়েছেন। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) একবার খেজুরপাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। মাদুরের দাগ তাঁর পবিত্র শরীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসুল, যদি আপনি অনুমতি দেন, তবে আমরা আপনার জন্য আরামদায়ক বিছানা তৈরি করে দিতাম, যাতে আপনার শরীরে দাগ না পড়ে।”

তিনি বললেন, “দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে এক মুসাফিরের মতো, যে কোনো একটি গাছের ছায়ায় সাময়িক আশ্রয় নেয়, তারপর সেই স্থান ত্যাগ করে পথচলা অব্যাহত রাখে।”’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪,১০৯)

আরও পড়ুন
এই দুনিয়ার জীবন তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়।
সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫

এই হাদিসে রাসুল (সা.) আমাদেরকে দুনিয়া দেখার দৃষ্টিভঙ্গি শিখিয়েছেন। তিনি নিজেকে তুলনা করেছেন এমন এক মুসাফিরের সঙ্গে, যে পথ চলার সময় সাময়িকভাবে একটু বিশ্রাম নেয়, একটু ছায়া খুঁজে নেয়, তারপর পুনরায় পথ চলতে শুরু করে।

দুনিয়া এই ছায়ার মতোই অস্থায়ী। একটু থামা, একটু বিশ্রাম, তারপর চলতে হবে—আসল ঠিকানা আখিরাতের দিকে। রাসুল (সা.) নিজেও দুনিয়ায় খুবই সাধারণ জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না। তিনি চেয়েছেন আমরা যেন আখিরাতের জন্যই বেশি প্রস্তুতি নিই।

কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এই দুনিয়ার জীবন তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)

আয়াতে ‘ধোঁকার উপকরণ’ বলার কারণ এই যে সাধারণত এখানকার ভোগবিলাসই হবে আখিরাতের কঠিন যন্ত্রণার কারণ। পক্ষান্তরে এখানকার দুঃখকষ্ট হবে আখিরাতের সঞ্চয়। তাই পার্থিব জীবনের এই ধোঁকা থেকে যে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে, সেই হবে ভাগ্যবান। আর যে এই ধোঁকার জালে ফেঁসে যাবে, সেই হবে ব্যর্থ ও হতভাগা।

আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.)-এর জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ, সরল ও দুনিয়া বিমুখতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ওমর (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে গেলাম। তাঁর পরিধানে ছিল শুধু একটি লুঙ্গি, এ ছাড়া কোনো জামা বা চাদর ছিল না। আমি দেখলাম, তিনি খেজুরপাতার একটি চাটাইয়ের ওপর শুয়ে আছেন, আর সেই চাটাইয়ের দাগ তাঁর পবিত্র পাঁজরে গভীরভাবে বসে গেছে।

আমি তাঁর ঘরের দিকে তাকালাম। দেখলাম, ঘরের এক কোণে কিছু গম, একটু বাবলাগাছের শুকনা পাতা, আর ঝুলন্ত একটি পানির মশক (চামড়ার পাত্র) ছাড়া কিছুই নেই।’

আরও পড়ুন
খাত্তাবের বেটা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে তাদের জন্য দুনিয়া আর আমাদের জন্য আখিরাত?
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪,১৫৩

এই দৃশ্য দেখে আমার চোখে অশ্রু চলে এল। রাসুল (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খাত্তাবের বেটা, কাঁদছ কেন?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহর রাসুল! আমি কেন কাঁদব না? আপনার পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গেছে, আপনার ঘরের এই সামান্য খাদ্যসামগ্রী আর পানি ছাড়া কিছুই নেই। আর কিসরা (পারস্যের রাজা) ও কায়সার (রোম সম্রাট) বিলাসিতায় জীবন যাপন করছে, প্রাসাদ, ঝরনা, উদ্যান—সব তাদের অধীনে। কিন্তু আপনি তো আল্লাহর রাসুল, তাঁর প্রিয়তম বান্দা। অথচ আপনার অবস্থা এ রকম!’

রাসুল (সা.) বললেন, ‘খাত্তাবের বেটা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে তাদের জন্য দুনিয়া আর আমাদের জন্য আখিরাত?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪,১৫৩)

আমাদের অবস্থা কি আজও কিসরা-কায়সারের মতো দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত, নাকি রাসুল (সা.)-এর মতো আখিরাত নিয়ে চিন্তিত? এই হাদিস আমাদের জন্য বড় শিক্ষা যে দুনিয়া এক মরীচিকা, আসল শান্তি আখিরাতে। রাসুল (সা.) আমাদের শেখালেন, ‘তুমি যদি আখিরাতের জন্য প্রস্তুত হও, তবে দুনিয়ার কষ্ট কোনো কষ্টই নয়।’

মাওলানা আজিজ আল কাউসার: খতিব, টোলারবাগ কেন্দ্রীয় মসজিদ

আরও পড়ুন