চার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

ছবি: ফ্রিপিক

ইসলামি শরিয়াহ বোঝা ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ফিকহ শাস্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ফিকহকে সুবিন্যস্ত ও প্রণালিবদ্ধ রূপ দিয়েছেন চারজন মহান মনীষী, যাঁদের আমরা চার ইমাম নামে জানি। তাঁরা ছিলেন ইসলামি ফিকহের চার মহান স্তম্ভ।

তাঁরা হলেন, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)। তাঁদের মাধ্যমে চারটি সুপরিচিত ফিকহি মাজহাব গড়ে ওঠে।

১. ইমাম আবু হানিফা (রহ.)

  • হানাফি মাজহাবের প্রবর্তক

  • পূর্ণ নাম: নু‘মান ইবনে সাবিত

  • জন্ম: ৮০ হিজরি, কুফা (বর্তমান ইরাক)

  • ইন্তেকাল: ১৫০ হিজরি, বাগদাদ

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন তাবেয়ি। তাবেয়ি বলা হয় যাঁরা আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদের দেখেছেন এবং তাদের সাহচর্যে ধন্য হয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন আলেম।

তিনি কোরআন ও হাদিসের পাশাপাশি কিয়াস (যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ) ও ইস্তিহসান ব্যবহারে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর মাজহাব বাস্তব জীবনের প্রয়োগে সহজ ও সুবিন্যস্ত হওয়ায় মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অনুসৃত।

তিনি রাজকীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। আব্বাসি খলিফার প্রস্তাবিত বিচারপতির পদ প্রত্যাখ্যান করায় তাঁকে কারাবরণ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

আরও পড়ুন

২. ইমাম মালেক (রহ.)

  • মালেকি মাজহাবের প্রবর্তক

  • পূর্ণ নাম: মালেক ইবনে আনাস

  • জন্ম: ৯৩ হিজরি, মদিনা

  • ইন্তেকাল: ১৭৯ হিজরি, মদিনা

ইমাম মালেক (রহ.) ছিলেন হাদিস ও সুন্নাহর এক মহান সংরক্ষক। তিনি মদিনাবাসীর আমলকে শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে গ্রহণ করতেন, কারণ মদিনা ছিল রাসুল (স.)-এর শহর।

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুয়াত্তা হাদিস ও ফিকহের প্রাচীনতম সংকলনগুলোর একটি। ইমাম মালেক (রহ.) অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন এবং মদিনায় বসেই সারা বিশ্বের ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন।

৩. ইমাম শাফেয়ি (রহ.)

  • শাফেয়ি মাজহাবের প্রবর্তক

  • পূর্ণ নাম: মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আশ-শাফেয়ি

  • জন্ম: ১৫০ হিজরি, গাজা

  • ইন্তেকাল: ২০৪ হিজরি, মিসর

ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ফিকহ ও উসুলুল ফিকহকে একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্র হিসেবে রূপ দেন। তাঁকে উসুলুল ফিকহের জনক বলা হয়। তিনি হানাফি ও মালিকি মাজহাবের জ্ঞান গ্রহণ করে দুয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন।

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আর-রিসালা উসুলুল ফিকহের ভিত্তিগ্রন্থ। তিনি কোরআন, সহিহ হাদিস, ইজমা ও কিয়াসকে শরিয়তের মূল উৎস হিসেবে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেন।

আরও পড়ুন

৪. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)

  • হাম্বলি মাজহাবের প্রবর্তক

  • পূর্ণ নাম: আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল

  • জন্ম: ১৬৪ হিজরি, বাগদাদ

  • ইন্তেকাল: ২৪১ হিজরি, বাগদাদ

ইমাম আহমদ (রহ.) ছিলেন হাদিসের ইমাম। তিনি যুক্তি ও কিয়াসের তুলনায় সহিহ হাদিসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তাঁর সংকলিত মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে প্রায় ৩০ হাজার হাদিস রয়েছে।

তিনি “কোরআন সৃষ্ট না অসৃষ্ট”—এই আকিদাগত বিষয়ে রাষ্ট্রীয় জুলুমের মুখেও সত্য থেকে সরে আসেননি। এজন্য তাঁকে কারাবরণ ও কঠোর নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু তিনি আপসহীন ছিলেন।

চার ইমামের প্রতি আহলুস সুন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গি

চার ইমামই ছিলেন কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী। তাঁরা কেউই নিজের মতকে চূড়ান্ত মনে করতেন না। বরং প্রত্যেকেই বলেছেন, “আমার কথা কোরআন ও সুন্নাহর বিপরীত হলে তা পরিত্যাগ করো।”

অতএব, মাজহাব মানা মানে অন্ধ অনুসরণ নয়; বরং সুসংগঠিতভাবে কোরআন-সুন্নাহ অনুসরণ করা।

চার ইমাম ইসলামের কোনো নতুন বিধান সৃষ্টি করেননি; বরং তাঁরা কোরআন ও সুন্নাহকে গভীর জ্ঞান, তাকওয়া ও ইখলাসের সঙ্গে বুঝে উম্মাহর জন্য সহজ করে উপস্থাপন করেছেন।

তাঁদের অবদান ছাড়া আজকের ফিকহি ঐতিহ্য কল্পনাই করা যায় না।

আরও পড়ুন