সুদ সম্পর্কে কোরআনের আয়াত
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঋণ ও অর্থনৈতিক লেনদেন সবসময়ই ছিল। তবে সুদ বা রিবা সেই লেনদেনের এক নিষ্ঠুর রূপ, যা ধনীকে করে আরও ধনী আর গরিবকে ঠেলে দেয় দারিদ্র্যের অন্ধকারে। ইসলাম এসেছে মানবকল্যাণের জন্য—তাই কোরআনে সুদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
কোরআনে সুদ সম্পর্কিত আয়াতগুলো
১. সুদে লিপ্তরা শয়তানে আচ্ছন্ন: “যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতের দিন সেই লোকের মতো দাঁড়াবে যাকে শয়তান আচ্ছন্ন করে পাগল করে দেয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৫)
এই আয়াত বলে দিচ্ছে—সুদখোর মানুষের আত্মা ও নৈতিকতা ধ্বংস হয়ে যায়, তার মানসিক স্থিরতা হারিয়ে যায়। (তাফসীর ইবনে কাসীর, দারুস সালাম, রিয়াদ: ২০০৩, খণ্ড ১, পৃ. ৭১৮)
২. আল্লাহর যুদ্ধ ঘোষণা: “হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বাকি আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হও। আর যদি তা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ৭৮-২৭৯)
কোরআনের কোথাও অন্য কোনো গোনাহের জন্য এভাবে সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের যুদ্ধ ঘোষণার কথা আসেনি। সুদ এখানে ব্যতিক্রম। (সায়্যিদ কুতুব, ফি জিলালিল কোরআন, দারুশ শুরুক, কায়রো: ২০০০, খণ্ড ১, পৃ. ৩৪৫)
৩. সুদ ধ্বংস করে, দান বৃদ্ধি করে: “আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন আর সদকা বা দানকে বাড়িয়ে দেন।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৬)
আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন—সুদ থেকে অর্থ বাড়তে দেখালেও তার মধ্যে কল্যাণ নেই। অন্যদিকে দান হয়তো কম দেখায়, কিন্তু তাতে আছে প্রকৃত বরকত। (তাফসীর আত-তাবারী, দারুল মাআরিফ, কায়রো: ১৯৯৯, খণ্ড ৫, পৃ. ৪৩১)
৪. সামান্য সুদও হারাম: “হে মুমিনগণ, তোমরা দ্বিগুণ, ত্রিগুণ করে সুদ খেও না; আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩০)
এখানে বলা হয়েছে—সুদ যত সামান্যই হোক না কেন, তা ধীরে ধীরে বেড়ে সমাজকে ধ্বংস করে দেয়।
৫. পূর্ববর্তী জাতির সতর্কতা: “তাদের সুদের জন্য, যদিও তা থেকে তারা বিরত থাকার নির্দেশ পেয়েছিল, এবং অন্যায়ের কারণে আমরা তাদের ওপর শাস্তি দিয়েছিলাম।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১৬১)
আহলে কিতাবের (ইহুদি জাতি) কিছু লোক সুদে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের জন্য এটি ছিল আল্লাহর শাস্তির একটি কারণ।
কেন সুদ হারাম?
১. অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায়: সুদখোর সবসময় মুনাফা নিশ্চিত করে, ক্ষতির ঝুঁকি নেয় না। ফলে গরিব আরও গরিব হয়, ধনী আরও ধনী।
২. মানবিক সহানুভূতি নষ্ট করে: ঋণ সাধারণত নেওয়া হয় প্রয়োজনে। সেখানে সুদ হলো অসহায় মানুষকে আরও শোষণ করার উপায়।
৩. সমাজে ঘৃণা ও বিভেদ: সুদ নির্ভর অর্থনীতি সমাজে অবিশ্বাস, হিংসা ও দ্বন্দ্ব তৈরি করে। (ইউসুফ আল-কারজাভি, ইসলামে হালাল ও হারাম, দারুল কুতুব, বৈরুত: ১৯৮৫, পৃ. ২৪৫)
বিকল্প পথ: সুদমুক্ত অর্থনীতি
ইসলাম অর্থনীতিকে সুদমুক্ত করেছে এবং বিকল্প হিসেবে দিয়েছে—
ক্বারজে হাসানা (সুন্দর ঋণ): আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে সুদ ছাড়া ঋণ দেওয়া।
মুদারাবা ও মুশারাকা: ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব যেখানে লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগি হয়।
যাকাত ও সদকা: সমাজে সম্পদ প্রবাহকে ভারসাম্যপূর্ণ করা।
আজকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে সুদের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ঋণের বোঝা গরিব দেশের জনগণকে চেপে ধরে। উন্নত বিশ্ব আরও শক্তিশালী হয়। কোরআনের শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সুদমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি ছাড়া প্রকৃত মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব নয়। (মুহাম্মদ তাকি উসমানি, An Introduction to Islamic Finance, দারুল ইশআত, করাচি: ১৯৯৮, পৃ. ৩৪)