হেদায়েতের শুরু কেন এত কঠিন
হেদায়েতের পথে হাঁটা প্রথম দিকে বড় কঠিন মনে হয়। কারণ, এ পথ মসৃণ নয়; বরং কণ্টকাকীর্ণ। এ পথে থাকে হাজারো চেনা–অচেনা বিপদ।
নিজের নফস, শয়তানের কুমন্ত্রণা, কাছের ও দূরের মানুষের তাচ্ছিল্য, রাগ, বিরক্তি, উপেক্ষা—সবকিছুই এখানে জড়িয়ে থাকে। যখন নিজের স্বজনেরা হেদায়েতের পথ থেকে বহু দূরে থাকে, কোনো কথা শুনতে চায় না বা বুঝতে চায় না এবং উল্টো তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় উপেক্ষা ও তিরস্কার, তখন কষ্ট আরও গভীর হয়।
হেদায়েতের পথে প্রধান সমস্যা
হেদায়েতের পথে চলতে গিয়ে একজন মুসলিমকে প্রাথমিকভাবে যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হতে হয়:
১. অভ্যস্ত জীবনধারা ও নফসের বাধা: মানুষ তার পুরোনো অভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনধারার সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয় যে হঠাৎ নতুন পথ অনুসরণ করা তার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে কঠিন মনে হয়। যেমন সময়মতো নামাজ পড়া, বিশেষ করে ফজরের জন্য ঘুম থেকে জাগতে পারা অনেক চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। নফস বারবার ভালো কাজে বাধা দিতে থাকে এবং বলে, ‘আচ্ছা কাল থেকে শুরু করব।’
২. শয়তানের প্রভাব: রাসুল (সা.) বলেছেন, শয়তান চেষ্টা করবে মানুষকে ইমান ও সঠিক পথে বাধাগ্রস্ত করতে। পথের শুরুতে এই বাধা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। কোনো গুনাহে জড়িয়ে পড়ার জন্য শয়তান বারবার ওয়াসওয়াসা দেবে। ফিসফিস করে বলবে, ‘এটা তেমন কোনো গুনাহই নয়, সবাই কত গুনাহ করে!’
অনেকে হেদায়েতের পথে শুরুতে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন বা সাফল্য আশা করে। এতে বিষয়টি তার কাছে অনেক ভারী মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে হেদায়েতের পথে অটল থাকার জন্য ধৈর্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশ্রম একান্ত প্রয়োজন।
৩. ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা: মানুষের ইচ্ছাশক্তি শক্তিশালী না হলে নতুন কোনো নৈতিক বা আধ্যাত্মিক পথ গ্রহণ করা চ্যালেঞ্জিং হয়। তাই হেদায়েতের পথে চলার জন্য নিজের ক্ষতিকর অভ্যাসকে দূরে সরিয়ে ভালো অভ্যাস রপ্ত করার ইচ্ছাটাকে শক্তিশালী করতে হয়।
৪. পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব: পরিবার, বন্ধু বা সমাজ যদি সেই পথকে সমর্থন না করে বা বিদ্বেষ দেখায়, তবে শুরুটা আরও কঠিন হয়ে যায়। কাছের বন্ধু হয়তো বলল, ‘ধুর! একটা সিগারেট খেলে আর কী হবে!’ অথবা কাছের আত্মীয় হয়তো বলল, ‘এক দিনই তো, আজ পর্দা না করলে কিচ্ছু হবে না।’
কাছের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত সহ্য করা, দূরে থাকা মানুষের আঘাতের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ও কষ্টকর হয়।
৫. দ্রুত ফলাফলের আশা: অনেকে হেদায়েতের পথে শুরুতে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন বা সাফল্য আশা করে। এতে বিষয়টি তার কাছে অনেক ভারী মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে হেদায়েতের পথে অটল থাকার জন্য ধৈর্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশ্রম একান্ত প্রয়োজন।
নবীদের পরীক্ষা থেকে শিক্ষা
সব কটি বাধা হয়তো সবার ক্ষেত্রে থাকে না, তবুও হেদায়েতের পথে অটল থাকার পথটা মোটেই মসৃণ নয়।
এ সময়ে একটি বিষয় মাথায় গেঁথে নিতে হয়—এই কষ্ট শুধু আমাদের নয়, আল্লাহর প্রিয় রাসুল (সা.)–কেও এ পথ পাড়ি দিতে বিভিন্ন ধরনের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তিনি নিপীড়িত, অপমানিত, রক্তাক্ত হয়েছেন; এমনকি ‘পাগল’ বিশেষণেও বিশেষিত হয়েছেন।
অন্য নবী–রাসুলরাও একই পথের পথিক ছিলেন। বহু বিপদ–আপদ ও লাঞ্ছনা সহ্য করে গেছেন তাঁরা।
নবী–রাসুল হওয়ার পরও আল্লাহ তাঁদের পরীক্ষা নিয়েছেন। তাঁরা সেই পরীক্ষায় সবর করে, দোয়া করে আল্লাহর সাহায্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বান্দার সবর শিক্ষার জন্য নবীদের জীবনের পরীক্ষাগুলোই যথেষ্ট।
পথের শুরুটা হয় পরীক্ষা ও বিপদ দিয়ে। তারপর আসে সবর ও আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের সময়। আর পথের শেষটা হয় দীপ্তিময়—হেদায়েত, নুর ও বিজয় দিয়ে।’ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)
জান্নাতের পথ ও পরীক্ষার বাস্তবতা
মুমিনের জীবনের বাঁকে বাঁকে তো কষ্ট থাকাই স্বাভাবিক। তা না হলে মুমিন জান্নাতের প্রত্যাশা করবে কীভাবে? জান্নাত হলো এক নিখুঁত শান্তির স্থান। সেই চিরস্থায়ী জান্নাতের জন্য ক্ষণস্থায়ী কষ্টগুলো সহ্য করে যেতেই হবে।
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাত অপ্রিয় বস্তু দ্বারা বেষ্টিত এবং জাহান্নাম কামনা–বাসনা দ্বারা বেষ্টিত।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭,০৬৬)
এর অর্থ হলো, জান্নাতের পথ অবশ্যই বুক ভেঙে যাওয়া কষ্টে পরিপূর্ণ (যা নফসের বিরুদ্ধে যায়)। আর জাহান্নামের পথ কামনা–বাসনা দ্বারা বেষ্টিত; অনেক মোহনীয় ও মনোহর সুখের রঙে রাঙানো। আর এটাই বান্দার জন্য আল্লাহর এক পরীক্ষা।
দুনিয়ায় মুমিনকে সরবে বা নীরবে ভেতরের ও বাহ্যিক শত্রুদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মুমিনগণ, যখন তোমরা কোনো দলের মুখোমুখি হও, তখন অবিচল থাকো, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হও।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ৪৫)
পথের শেষটা দীপ্তিময়
হেদায়েতের পথে চলা মুমিনের জীবনের পরীক্ষা নিয়ে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) একটি গভীর সত্য বলে গেছেন, ‘মুমিনের জীবনে তার পথের শুরুটা হয় পরীক্ষা ও বিপদ দিয়ে। তারপর আসে সবর ও আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের সময়। আর পথের শেষটা হয় দীপ্তিময়—হেদায়েত, নুর ও বিজয় দিয়ে।’ (ইবনুল কাইয়্যিম জাওজি, তারিক আল–হিজরাতাইন ওয়া বাব আস–সাআদাতাইন)
এই বক্তব্যের মানে হলো, হেদায়েতের পথের শেষে বিজয় থাকবেই। যে চিরস্থায়ী বিজয়ের আশা করবে, সে ক্ষণস্থায়ী কষ্টে ভেঙে পড়বে না। মানুষের কথায়, তাচ্ছিল্যে, রাগে, অপমানে তার হৃদয় ভেঙে যাবে না। কারণ, সে জানে এসব সাময়িক, আর আল্লাহর পুরস্কার চিরস্থায়ী।
যখন বান্দা আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দিতে পারে, তখন তার হৃদয় আল্লাহর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কষ্ট ও ব্যথাগুলো ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে। আল্লাহর দয়ায় বান্দার মন শান্তি ও স্থিতিশীলতা অনুভব করতে শুরু করে।
হেদায়েতের পথে চলার শুরুটা তাই অনেক কঠিন হলেও শেষটা একসময় সহজ হয়ে যায়। আর এভাবেই বান্দা কষ্টের মধ্য দিয়েই সবর আর আল্লাহর ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করতে শিখে যায়। কাছে ও দূরের মানুষের বাঁকা কথা, উপেক্ষা অথবা বিরক্তি, কোনো কিছুই তাকে আর প্রভাবিত করতে পারে না। বান্দা এক অন্য রকম আলোয় পথ চলতে শুরু করে।
ইসমত আরা : শিক্ষক, লেখক