নবীজি (সা.)–এর দোয়া

সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত মসজিদে নববিছবি: ফেরদৌস ফয়সাল

নবীজি (সা.) একদিন বিশেষ এক দোয়া করলেন, হে আল্লাহ, ওমর বিন খত্তাব অথবা আবু জাহাল বিন হিশামের মধ্য থেকে যাকে তোমার পছন্দ হয়, তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী করো।

দোয়াটা নবীজি (সা.) করেছিলেন নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরে। ছয় বছর ধরে তিনি কঠোর পরিশ্রম করছেন। কালেমার দাওয়াত নিয়ে ঘুরছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি ইসলামের। প্রকাশ্যে নামাজ কিংবা কোরাআন তেলাওয়াতের মতো অনুকূল পরিবেশও তখনো আসেনি মুসলমানদের। উল্টো বেড়েছে নির্যাতন—শারীরিক এবং মানসিক। বেলাল (রা.)-এর গলায় রশি বেঁধে দুষ্ট ছেলেদের হাতে ছেড়ে দেয় তাঁর মনিব উমাইয়া বিন খলফ। যেন ইসলাম গ্রহণের কারণে তিনি মানুষের কাতার থেকে পশুর কাতারে নেমে গেছেন। মরু-দুপুরের প্রখর রোদে বালুর ভেতর চিৎ করে শুইয়ে তাঁর বুকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ভারী পাথর। মক্কার প্রভাবশালী ধনী ব্যবসায়ী ওসমান (রা.) ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাঁকেও সইতে হচ্ছে চাচার অত্যাচার। ইতিমধ্যে ঘটে গেছে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম রক্তপাতের ঘটনা। আবু জাহাল লজ্জাস্থানে বর্শা গেঁথে শহীদ করে দিয়েছে সুমাইয়াকে। ইসলামের প্রথম শাহাদাতের গৌরব অর্জন করেছেন একজন নারী। আর তাঁর স্বামী ইয়াসির, তাঁকেও শহীদ করা হয়েছে অত্যন্ত নির্মমভাবে। সেই বিবরণ দিতে গিয়ে থমকে যায় ইতিহাসের কলম। জল আসে পাষাণের চোখেও। ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহুর দুই পায়ে দুটো রশি বেঁধে রশির অপর দুই প্রান্ত বাঁধা হয়েছিল বিপরীতমুখী দুটো উটের সাথে। এরপর ছুটিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই উট জোড়া। ইয়াসির আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন দ্বিখণ্ডিত শরীর নিয়ে। আর এই শহীদ দম্পতির ছেলে আম্মার, আবু জাহালরা তাঁকেও শুইয়ে রাখে মরুভূমির তপ্ত বালু আর কংকরের ভেতর, চাপ দিতে থাকে মুহাম্মদ (সা.)–এর ধর্ম ত্যাগ করার জন্য। আহা! তাঁদের সেই রক্তের ওপরই নির্মিত হয়েছে আজকের ইসলামের সুরম্য প্রাসাদ।

আরও পড়ুন

শাগরেদদের এই দুরবস্থার বেদনা সইতে না পেরে নবীজি (সা.)  একদিন ব্যথিত হৃদয়ে ওপরের দোয়াটা করলেন। এর কদিন পরই রাদিয়াল্লাহু আনহুতে পরিণত হলেন ইসলামের চরম শত্রু ওমর। ওমর ও আবু জাহাল তৎকালীন মক্কার প্রবল ক্ষমতাধর, সাহসী দুই ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নেই। তাই বলে তাঁরা অপ্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন না। মক্কায় তাঁদের মতো দুঃসাহস ও প্রতিপত্তি আরও অনেকের মধ্যেই ছিল। তবু সবাইকে রেখে এই দুজনের একজনের কবুলিয়াতের দোয়া করাটা নবিজির বিচক্ষণতার স্বাক্ষর বহন করে। নবীজি (সা.)–এর দোয়া ওমরের জন্য কবুল হয়েছিল আর তারপরই ইসলাম মক্কায় কোমর সোজা করে দাঁড়ায়। প্রকাশ্যে নামাজ ও তাওয়াফ শুরু হয়। সাহাবিরা চিৎকার করে মক্কার অলিগলিতে কালিমার ধ্বনি ছড়িয়ে দেন।

ওমর। আহা ওমর। যাঁর নাম বাদ দিয়ে ইসলামের ইতিহাস কল্পনা করা যায় না। যাঁর খেলাফতকাল আমাদের সোনালি অতীত। যার বীরত্ব, সাহসিকতা আর বিজয়ের গল্প আমাদের গৌরবগাথা। খেজুরপাতার প্রাসাদে বসে অর্ধজাহান শাসন করার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁরই। এখনো সাম্যের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখা একজন তরুণের সামনে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ ওমরের শাসনকাল। ওমর (রা.) না থাকলে হয়তো ইসলামের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। তাঁর আকাঙ্ক্ষার দাম দিতে গিয়ে প্রবর্তিত হয়েছে শরিয়তের অনেক বিধান। ইসলামের অনেক সিদ্ধান্তে তাঁর আর আল্লাহর মতামত মিলে গেছে এক মোহনায়। তাঁর ব্যাপারেই নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যদি আমার পরে কেউ নবী হতো, সে হতো ওমর।’

ওমর(রা.)–এর মাধ্যমে ইসলামের বিজয়ডংকার এই যে বেজে ওঠা দিকে দিকে, তার বীজ কি বপিত ছিল নবীজির (সা.) ওই দোয়ার ভেতরে, ইসলামের শৈশবকালে? আর সবাইকে রেখে নবীজি (সা.) ঠিক কেন ওমর (রা.)–এর জন্যই ব্যাকুল হয়েছিলেন সেদিন? তাঁর দূরদর্শী চোখ কি তবে ওমরের কাফের চোখে জ্বলতে দেখেছিল ইসলামের প্রত্যুজ্জ্বল দীপশিখা?

সূত্র : প্রজ্ঞায় যার উজালা জগৎ

আরও পড়ুন