মক্কায় পৌঁছে বিকেলে ওমরাহ

শনিবার ৩ জুন ভোরের আলো ফোটার বেশ আগেই বিমান জেদ্দা বিমানবন্দরে নামল। বিমান থেকে নামার পর একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম বাংলাদেশ হজ মিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত আছেন বাংলাদেশি হাজিদের স্বাগত জানাতে। বিমানবন্দরের কর্মীরাও ‘হজে মাবরুর’ বলে খেজুর বিতরণ করছিলেন। ইমিগ্রেশন তো ঢাকায় সেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের তাই আশেপাশে দাঁড়ানোর বা অপেক্ষার কোনো সুযোগ না দিয়ে প্রায় প্রহরা দিয়ে নিয়ে সোজা বাসে তুলে দেওয়া হলো। এ কাজে আরব নিরাপত্তা রক্ষীদের পাশাপাশি কয়েকজন বাংলাদেশি সহকারী ছিল। আমার সহধর্মিণীসহ অনেকেই টয়লেটে যেতে চাচ্ছিলেন। তাদের বলা হলো বাসের ভেতরের টয়লেট ব্যবহারের জন্য। আর বাসে ওঠার আগে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হলো। অনেকেই ইতস্তত করছিলেন যদিও ঢাকা থেকেই বিষয়টা আমাদের জানা। আর বাস নির্ধারিত হোটেলে বা বাড়িতে ঠিকমতো নিয়ে যাবে কিনা তা নিয়েও কারও কারও মনে শঙ্কা জেগেছিল। তবে ওখানে বাংলাদেশি কর্মীরা সবাইকে আশ্বস্ত করলেন।

জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ চলার পর মক্কার প্রবেশমুখে স্থাপিত চেকপোস্টে থামতে হলো। নিরাপত্তা কর্মীরা বাস চালকের কাগজপত্র পরীক্ষা করল। তারপর আবার বাস ছাড়ল। একটু পরেই আবার থামা। না। এবার খাবারের প্যাকেট আর জমজমের ঠান্ডা পানি বিতরণ করতে ভেতরে উঠেছে স্বেচ্ছাসেবকের। নিজেদের বড় সৌভাগ্যবান মনে হলো। আল্লাহর মেহমানদের সবাই যে যার মতো সহায়তা করছে, খেদমত করছে সেই ঢাকা থেকেই।

আরও পড়ুন

আরও প্রায় ২০ মিনিট পরে মিসফালা এলাকায় হিজরা রোডে আমাদের বাস থামল। সেখানে মোয়াল্লেমের প্রতিনিধি একজন বাংলাদেশি উঠে আমাদের স্বাগত জানালেন আর বললেন যে আমাদের বাড়ি নম্বর ১৬। আসলে এটা একটা হোটেল। এ রকম বিভিন্ন হোটেলকে বাড়ি হিসেবে অভিহিত করা হয় ও নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয় যেন চিনতে সুবিধা হয়। বাংলাদেশের সরকারি হাজিদের ১৬ নম্বর বাড়িটি ছিল হোটেল ‘মাসার আল-জাওয়ার’। হিজরা মসজিদকে হাতের ডানে রেখে সামনে কয়েক মিটার এগিয়ে গেলে হাতের বামদিকে হোটেলটির অবস্থান।

বাস থেকে নেমে হাত ব্যাগগুলো নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম হোটেলের লবিতে। ব্যস্ত কর্মীরা আমাদের গলায় ঝোলানো ছবিসম্বলিত পরিচয়পত্র দেখে মিলিয়ে কোন তলায় কতো নম্বর কক্ষ বরাদ্দ তা বলে দিচ্ছিলেন। আমরা নবম তলায় কক্ষ বরাদ্দ পেলাম। ২০তলা ভবনের সুবিশাল হোটেলটিতে ছয়টি লিফট। হাজীদের চাপ বেশি থাকায় একটু সময় নিয়ে উঠতে হলো। নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে দেখি, সাথে আরো যাঁরা থাকবেন, তাঁরা আগেই চলে আসতে পেরেছেন। আমার কক্ষে আছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ফারুক ভাই আর তরুণ উদ্যোক্তা তানজীর আহমেদ। পাশের কক্ষেই আমার সহধর্মিণীর সাথে থাকছেন ওদের দু’জনের সহধর্মিণী এবং তানজীরের আম্মা।

আরও পড়ুন

যেহেতু রাতের ঘুম ঠিকমতো হয়নি, তাই গোসল সেরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়াই সঠিক মনে করলাম। আমাদের দলের কেউ কেউ অবশ্য ওমরাহ করার জন্য বেড়িয়ে পড়েছেন দেরি না করেই। আমরা বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেলাম সেরে বাইরের একটা বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয়। খাওয়া সেরে আবার যখন হোটেলে এলাম, তখন দেখি লবিতে লাগেজ চলে এসেছে। ফলে যে যার লাগেজ নিয়ে রুমে এলাম। তারপর আসরের সালাত আদায় করে রওনা দিলাম ওমরাহ করতে।

দুই.

মিসফালা এলাকার কবুতর চত্বর পেরিয়ে মসজিদুল হারামের বাইরের প্রাঙ্গণে যেতে পায়ে হেঁটে ১২ থেকে ১৫ মিনিট। বাদশা ফাহাদ ফটক, যেটি ৭৯ নম্বর গেট হিসেবেও পরিচিত, দিয়ে প্রবেশের আগে পায়ের চপ্পল খুলে কাঁধের ব্যাগে ভরে নিলাম।

দেড় বছর আগে জীবনের প্রথম ওমরাহ করতে এসেছিলাম। তখন করো না মহামারির পর ধীরে ধীরে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া মাত্র শুরু হয়েছে। ফলে নির্ধারিত সময়ের বাইরে ওমরাহর জন্য ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এখন আর তা নেই। তাই আমাদেরও ভেতরে যেতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

আরও পড়ুন

পবিত্র কাবাঘর চোখে পড়তেই মনে মনে দোয়া করলাম, ‘আল্লাহ এই হজ সফরে আমাদের সব দোয়া কবুল করে নাও, আমাদের হজ সহজ করে দাও।’ তাওয়াফের নিয়তে মাতাফে নামার পর হাতের ডানে সবুজ বাতি খেয়াল করে ওটা বরাবর হাতের বায়ে হজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে দু’হাত তুলে ’বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে তাওয়াফ শুরু করলাম। কাছে যেয়ে হজরে আসওয়াদ ছোঁযা বা চুম্বন করার মতো সুযোগ ছিল না হাজিদের বিপুল সমাগমে। আমার যেন প্রথম কেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি কাবার এত কাছে এসেছি এবং তাওয়াফ করছি। ওমরাহর তাওয়াফে প্রথম তিন চক্করে ছেলেদের রমল করতে বা বীরদর্পে চলতে হয়। আবার রুকুনে ইয়ামেনি থেকে হজরে আসওয়াদ পর্যন্ত ‘রব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতও, ওয়াকিনা আজাবান নার। ওয়াদখিলনাল জান্নাতা মাআল আবরার, ইয়া আজিজু ইয়া গাফফার, ইয়া রব্বাল আলআমিন’ - এই দোয়াটি বারবার পড়া সুন্নাহ। এছাড়া তাওয়াফের বাকি সময়টাও কোনো নির্ধারিত দোয়া নেই। বরং বারবার ইস্তিগফার পড়াসহ আপন মনে আল্লাহর কাছে নিজ ভাষায় প্রাণখুলে দোয়া করতে হয়।

সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করে বেশ খানিকটা পিছিয়ে এসে মাতাফের শেষ প্রান্তে মানে যেখানে মাতাফের পরই মসজিদুল হারামের সম্প্রসারিত অংশের সুবিশাল পিলারগুলো শুরু তার একটু সামনে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে নিলাম। মাকামে ইব্র্রাহিমের ঠিক পেছনে সুযোগ ছিল না। এরপর জমজমের পানি পান করলাম প্রাণ ভরে। আমার সহধর্মিণী আরও কিছুক্ষণ ওখানে থেকে কাবা অবলোকন করতে চাইছিল। কিন্তু পুলিশ বাদ সাধল। আমরাও তাই দ্রুত হাঁটা দিলাম সাফা-মারওয়ার দিকে সাঈ করার জন্য। এসময়ও প্রাণখুলে নিজের মতো দোয়া করাটা জরুরি। সাফা থেকে শুরু করে সাত চক্করে সাঈ মারওয়ায় শেষ করে বের হয়ে এলাম।

এবার জমজমের পানি ভরে নিলাম সঙ্গে থাকা দুটো বোতলে। এখন চুল কেটে হালাল হতে হবে। এদিকে মাগরিবের ওয়াক্ত আসন্ন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আজান হলো। আমরা বাইরেই সালাত আদায় করে নিলাম। এরপর হোটেলে ফেরার পথে আমি চুল ছেঁটে নিলাম একটা পাকিস্তানি সেলুনে। আর হোটেলে ফেরার সামান্য পরেই দেখি সৌদি আরবের বিখ্যাত আল-বায়েকের মুরগি ভাজা ও রুটির বাক্স চলে এসেছে সবার জন্য। এটা হলো ওয়েলকাম মিল। সেই সঙ্গে জনপ্রতি দু’বোতল করে জমজমের পানি।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।

আরও পড়ুন