ইসলামের ৩টি স্তর: আমরা কোন স্তরে আছি
খুব সহজেই অনেক সময় বলে ফেলি আমরা মুমিন, আমরা ইমানদার। অথবা, আমার গর্ব আমি একজন মুসলিম, আমি ইসলাম পালন করছি এটাই যথেষ্ট, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমাদের ধর্মেও কিছু স্তর থাকতে পারে? শুধু মুসলিম হওয়া কিন্তু আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়।
হ্যাঁ, আমাদের ইসলামে স্তর রয়েছে। কোন কোর্স করতে হলে যেমন, এক একটি লেভেল শেষ করে চূড়ান্ত লেভেলে পৌঁছতে হয়, ইসলামেও তেমনি মর্যাদার এক একটি লেভেল শেষ করে চূড়ান্ত লেভেলের মর্যাদায় উন্নীত হতে হয়।
আমরা কোন স্তরে আছি তা জানা একান্ত প্রয়োজন। যদি সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করি, তাহলে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে।
শুধু মুসলিম হলেই হবে না, ইসলামে প্রবেশ করে গুটিকতক আদেশ-নিষেধ মানলেই হবে না; পরিপূর্ণ শান্তির ইসলামে প্রবেশ করতে হলে এক এক করে দুটি স্তর অতিক্রম করে তৃতীয় স্তরে আমাদের পৌঁছতে হবে। তবেই আমরা পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করতে পারব। ইসলাম যে আসলেই একটি শান্তির ধর্ম সেটা তখন অনুভব করতে পারব।
ইসলাম ধর্মে তিনটি স্তর রয়েছে। প্রাথমিক স্তর: ইসলাম, মধ্যম স্তর: ইমান এবং সর্বোচ্চ স্তর: ইহসান।
প্রাথমিক স্তর: ইসলাম
ছোটবেলায় পড়ে এসেছি ইসলাম অর্থ শান্তি। অথচ ইসলাম অর্থ শান্তি নয়, ইসলাম অর্থ ‘আত্মসমর্পণ করা’। তবে ইসলাম শব্দটি আরবি যেই ধাতু থেকে এসেছে, সিন-লাম-মিম, তা দিয়ে ‘সালাম’ হয়, তার অর্থ শান্তি। শুধু ইসলাম অর্থ শান্তি বলা সঠিক নয়। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করলেই শান্তির কাছে আশ্রয় পাওয়া যাবে।
পরিভাষায় ইসলাম মানে হচ্ছে, আল্লাহর এককত্ব (তাওহিদ) মেনে নেওয়া, তাঁর পূর্ণ আনুগত্ব করা (আত্মসমর্পণ করা) এবং শিরকের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করা। এই তিনটি শর্তের তিনটিই যার মধ্যে থাকবে সে ইসলাম ধর্মের প্রথম ধাপের সদস্য ‘মুসলিম’ বলে গণ্য হবে।
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি; যা বাল্যকালেই মোটামুটি সব মুসলিমের জানা হয়ে যায়। এ পিলারগুলো হচ্ছে: ১. মুখ ও অন্তর থেকে এ ঘোষণা দেওয়া যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো ইবাদতের উপযুক্ত নেই, এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।’ ২. নামাজ কায়েম করা, ৩. জাকাত আদায় করা, ৪. রমজান মাসে রোজা পালন করা এবং ৫. সামর্থ্য থাকলে হজ করা। এই ভিত্তির সবগুলো যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করাই একজন মুসলিমের অবশ্য করণীয়।
মধ্যম স্তর: ইমান
ইমান অর্থ, কোনো কিছুকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। পরিভাষায় ইমান মানে হলো, অন্তরে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকার করা এবং বাস্তবে আমলে পরিণত করা। ইমানের ভিত্তি ছয়টি:
আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর, তাহলে তিনি তোমাদের আমলসমূহের কোন কিছুই হ্রাস করবেন না।সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৪
১. আল্লাহর প্রতি ইমান রাখা। মানে এটা বিশ্বাস করা যে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা, রিজিকদাতা, পরিপূর্ণ গুণের অধিকারী ও সবধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত।
২. আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রতি ইমান রাখা। মানে তাদেরকে এভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর সম্মানিত, অনুগত বান্দা হিসেবে।
৩. আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত আসমানি কিতাবগুলোর প্রতি ইমান রাখা।
৪. আল্লাহর পক্ষ থেকে আগমনকারী নবী-রাসুলগণের প্রতি ইমান রাখা।
৫. পরকালের প্রতি ইমান রাখা। অর্থাৎ মানুষকে মৃত্যুর পর কিয়ামতের দিন আবার জীবিত করে উঠানো হবে এবং হিসাব গ্রহণ করা হবে; এটা বিশ্বাস করা এবং মেনে নেওয়া।
৬. তকদির অর্থাৎ ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি ইমান রাখা।
এই ছয়টি বিষয় মুখে বলতে হবে, অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে হবে আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনও ভিন্নতা থাকা যাবে না। শুধু বিশ্বাস করবো, কিন্তু মানব না, এমন বিশ্বাসের ভিত্তি নেই। আল্লাহ বলেছেন, ‘মরুবাসীরা বলল, আমরা ইমান আনলাম। আপনি বলুন, তোমরা ইমান আনোনি। বরং তোমরা বলো, আমরা আত্মসমর্পণ করলাম। আর এখন পর্যন্ত তোমাদের অন্তরে ইমান প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর, তাহলে তিনি তোমাদের আমলসমূহের কোনো কিছুই হ্রাস করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৪)
এ থেকে বোঝা যায়, জ্ঞানার্জন এবং শক্ত বিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে না উঠলে একজন মুসলিম ব্যক্তি সারাজীবন মুসলিম থেকে যাবে, মুমিনের স্তরে পৌঁছাতে পারবে না।
সর্বোচ্চ স্তর: ইহসান
ইহসান অর্থ হচ্ছে, কোনো কাজ সুন্দরভাবে করা। সেটা যেকোনো কাজ হতে পারে। পরিভাষায় ইহসান হলো, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে সুন্দর ও নিখুঁতভাবে এটা মনে করে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে যেন আল্লাহকে আমরা দেখছি। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে দৃঢ় ভাবে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদেরকে দেখছেন।
জিবরাইল (আ.) যখন রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, ইহসান বলতে কী বুঝায়? তখন তিনি বললেন, ‘ইহসান হলো, তুমি একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এমন সুন্দর ও নিখুঁতভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যে, তুমি যেন তাঁকে দেখছো। আর যদি তা মনে করতে না পারো, তাহলে অন্তত এটুকু মনে করবে যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।
আল্লাহকে আমরা দেখছি এটা হয়তো আমরা মনে করতে পারব না বা মনে করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের ছোট-বড় যে-কোনো কাজের ক্ষেত্রে এটা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ আমাদের প্রতিটি কাজ দেখছেন, সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজও আমাদের দ্বারা করা সম্ভব নয়।
তুমি এমন সুন্দরভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যে, তুমি যেন তাঁকে দেখছো। আর যদি তা মনে করতে না পারো, তাহলে অন্তত এটুকু মনে করবে যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।
পরিপূর্ণ ইহসান যাদের মধ্যে থাকে তাদের বলা হয় ‘মুহসিনিন’ বলা হয়।
এই স্তরগুলো সম্পর্কে জানা কেন জরুরি?
আমরা কোন স্তরে আছি তা জানা একান্ত প্রয়োজন। যদি সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করি, তাহলে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে। আর যদি দেখি সর্বোচ্চ স্তরে পোঁছে গেছি, তাহলে স্তরটি ধরে রাখার জন্য অর্থাৎ শয়তান যেন নীচের স্তরে আবার নামাতে না পারে সেজন্য সচেতন থাকতে পারব।
ইমান, তাকওয়া, ইখলাস ও নেক আমলের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা নীচ থেকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পারেন। আবার ইমান-আমলে অবহেলা করলে বা এগুলোর ত্রুটির কারণে উপরের স্তর থেকে একদম সর্ব-নিম্নস্তরেও নেমে যেতে পারেন। এজন্য স্তরগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন করার বিকল্প নেই।
আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সুন্দরভাবে সৎকর্ম বাস্তবায়ন কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ‘মুহসিনিন’কে (সুন্দরভাবে সৎকর্মকারীদের) ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫)
ইসমত আরা: লেখক ও শিক্ষক