কেন ‘আসমাউল হুসনা’ জানতে হবে
আল্লাহ তাআলার সুন্দর নামগুলো জানা কেবল একটি তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং এটি ইলম (জ্ঞান), আমল (কাজ) এবং দোয়ার একটি সমন্বিত মাধ্যম। এই নামগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আল্লাহর পূর্ণতা, রহমত ও ন্যায়বিচারের প্রমাণ।
একজন মুমিন যখন তাঁর রবের নামগুলো অন্তর দিয়ে অনুভব করে, তখন তার জীবন এক নতুন অর্থ খুঁজে পায়।
‘আসমাউল হুসনা’ কী
আল্লাহর নাম অগণিত। তিনি তাঁর কিতাবে এবং রাসুলের সুন্নাহর মাধ্যমে আমাদের কিছু নাম জানিয়েছেন, আবার এমন অনেক নাম আছে যা তিনি কেবল নিজের কাছেই রেখেছেন।
একটি হাদিসে রাসুল (সা.) দুঃখ ও দুশ্চিন্তা মুক্তির একটি দোয়া শিখিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার সেই প্রতিটি নামের উসিলায় প্রার্থনা করছি, যে নামে তুমি নিজেকে নামাঙ্কিত করেছ, অথবা তোমার কিতাবে অবতীর্ণ করেছ অথবা তোমার সৃষ্টির কাউকে শিখিয়েছ অথবা যা তুমি নিজের কাছে ইলমে গায়েবে (অদৃশ্য জ্ঞানে) গোপন রেখেছ।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৩,৭১২)।
এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে আল্লাহর সব নাম আমরা জানি না। তবে যে নামগুলো জানানো হয়েছে, সেগুলো শেখার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যারা এই নামগুলো জানবে, তাদের উচিত অন্যদের তা শেখানো। (ইবনুল কাইয়িম, আল-কাওয়াইদুল মুসলা, পৃষ্ঠা: ৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৩)
আল্লাহর নাম অগণিত। তিনি তাঁর কিতাবে এবং রাসুলের সুন্নাহর মাধ্যমে আমাদের কিছু নাম জানিয়েছেন, আবার এমন অনেক নাম আছে যা তিনি কেবল নিজের কাছেই রেখেছেন।
আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ জানার ফজিলত
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি বিখ্যাত হাদিসে ৯৯টি নামের বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম রয়েছে—এক কম একশত; যে ব্যক্তি এগুলো ‘ইহসা’ করবে বা রক্ষণাবেক্ষণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৭৩৬)
এখানে ‘ইহসা’ শব্দের অর্থ কেবল সংখ্যা গণনা নয়। ওলামায়ে কেরাম এর চারটি স্তর উল্লেখ করেছেন:
১. মুখস্থ করা: নামগুলো স্মরণে রাখা।
২. অর্থ বোঝা: প্রতিটি নামের গভীর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করা।
৩. আমল করা: নামের দাবি অনুযায়ী জীবন গড়া। যেমন— আল্লাহ ‘আহাদ’ (একক) জানলে অন্য কাউকে তাঁর অংশীদার না করা; আল্লাহ ‘রাজ্জাক’ জানলে অন্য কারো কাছে জীবিকা প্রার্থনা না করা।
৪. দোয়া করা: নামগুলোর উসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
শাইখ ইবনে বায (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, নামগুলো মুখস্থ করা জান্নাতে প্রবেশের একটি মাধ্যম, যদি বান্দা কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং আল্লাহর হক আদায় করে। (ফাতাওয়া ইবনে বায, ৪/৭৬, দারুল কুতুব, রিয়াদ, ২০০১)
কেন সুন্দর নামসমূহ জানা জরুরি
আসমাউল হুসনা বা আল্লাহর সুন্দর নামের জ্ঞান লাভ করা অন্য সকল জ্ঞানের চেয়ে উত্তম। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান: কোনো জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে তার আলোচ্য বিষয়ের ওপর। যেহেতু এই ইলমের আলোচ্য বিষয় স্বয়ং মহান আল্লাহ, তাই এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান। (ইবনুল কাইয়্যিম, বাদায়িউল ফাওয়াইদ, ১/১৬৩, মাকতাবাতু নিযার মুস্তফা আল-বায, মক্কা, ১৯৯৬)
হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয় সৃষ্টি: আল্লাহকে যত বেশি জানা যাবে, তাঁর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা তত বাড়বে। তাঁর দয়ার নামগুলো জানলে মনে আশার সঞ্চার হয়, আবার তাঁর কঠোরতার নামগুলো জানলে মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়। এটিই মুমিনের জীবনের ভারসাম্য।
যারা নামগুলো শুধু মুখে আওড়ায় কিন্তু আমল করে না, তারা সেই খারিজিদের মতো যারা কোরআন পড়ে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে নামে না।ইবনে বাত্তাল (রহ.)
ইমান বৃদ্ধি: আবদুর রহমান আস-সাদী (রহ.) বলেন, আল্লাহর সুন্দর নামগুলোর ওপর ইমান আনার মধ্যে তওহিদের সকল প্রকারই অন্তর্ভুক্ত। এই জ্ঞানই ইমানের আত্মা ও মূল ভিত্তি। (আত-তাওযিহ ওয়াল বয়ান লি শাজারাতিল ইমান, পৃষ্ঠা: ৪১, মাকতাবাতুল ফাহদ, রিয়াদ, ২০০০)
সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল করা: আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন তাঁর পরিচয় জানার জন্য। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, রাসুলদের দাওয়াতের সারকথা ও চাবিকাঠি হলো মহান মাবুদকে তাঁর নাম, গুণ ও কাজের মাধ্যমে চেনা। (আস-সাওয়াইকুল মুরসালা, ১/১৫০, দারুল আসিমা, রিয়াদ, ১৯৯৮)
যান্ত্রিকতা বনাম আধ্যাত্মিকতা
অনেকে আসমাউল হুসনাকে কেবল একটি মন্ত্রের মতো পাঠ করেন। কিন্তু পূর্বেকার আলেমদের মতে, এর মূল উদ্দেশ্য হলো জীবন ও চরিত্রে তার প্রতিফলন ঘটানো। কেননা, কেবল গুণে গুণে মুখস্থ করা তো কোনো পাপাচারীও করতে পারে, কিন্তু প্রকৃত সার্থকতা হলো এর মর্ম উপলব্ধি করা।
ইবনে বাত্তাল (রহ.) সতর্ক করেছেন যে, যারা নামগুলো শুধু মুখে আওড়ায় কিন্তু আমল করে না, তারা সেই খারিজিদের মতো যারা কোরআন পড়ে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে নামে না। (বাদায়িউল ফাওয়াইদ, ১/১৬৪, মাকতাবাতু নিযার মুস্তফা আল-বায, মক্কা, ১৯৯৬)
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যখন জানে আল্লাহ ‘লতিফ’ (অতি সূক্ষ্মদর্শী/দয়ালু), তখন সে মানুষের সঙ্গে লেনদেনে কোমল ও দয়ালু হওয়ার চেষ্টা করে। যখন সে অনুভব করে আল্লাহ ‘রাকিব’ (পরিপূর্ণ পর্যবেক্ষক), তখন সে গোপনেও পাপ করতে ভয় পায়। এই নৈতিক পরিবর্তনই হলো আসমাউল হুসনা চর্চার আসল ফসল।
সুতরাং, আমাদের প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিনের ব্যস্ততার মাঝে কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখা এই মহান নামগুলোর অর্থ বুঝতে এবং হৃদয়ে ধারণ করতে। তবেই আমাদের জীবন হবে সার্থক এবং জান্নাতের পথ হবে সুগম।