মহানবীর (সা.) বিশদ জীবনী

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম জীবনীগ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে ইবনে ইসহাকের নাম প্রায় সবারই জানা। তাঁর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বিন ইয়াসার। পারিবারিকভাবেই তিনি আরবের বংশ-গোত্রের বিস্তারিত পরিচয়সহ অতীতের বিভিন্ন ঘটনা সংকলনের মাধ্যমে আরব্য উপদ্বীপের ইতিহাস রচনার দীক্ষা নিয়েছিলেন। এই দীক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর রচিত সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বইটির মধ্যে।

বলে রাখা দরকার, আরববাসীরা তাদের অসাধারণ স্মৃতিশক্তির জন্য খ্যাত ছিল। সে কারণে তাদের মুখে মুখে অতীতের বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিবরণ ঘুরে বেড়াত। সে সময়টায় লেখার চল ছিল কম। তবে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় টুকে রাখত, যা বংশ–পরম্পরায় হাতবদলের মাধ্যমে সংরক্ষিত হতো। এসব টোকার সঙ্গে মিলে স্মৃতি থেকে বিবরণী যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠত।

আরও পড়ুন

এ ধরনের চর্চায় প্রশিক্ষিত ইবনে ইসহাক আব্বাসীয় শাসনামলের প্রথম দিকে দ্বিতীয় খলিফা বা বাদশা আল মনসুরের সময়কালের মধ্যবর্তী সময়ে (আনুমানিক ৭৬১ থেকে ৭৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) বইটি রচনা করেন। মানে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর ইন্তেকালের দেড়শ বছরের মধ্যে এটি রচিত।

এ বই মূলত মহানবী (সা.)-এর জীবন ও কর্মের এক বিস্তারিত বিবরণ, যেখানে পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতি ও নবী-রাসুলদের সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে। এ কাজে তিনি সহায়তা পেয়েছেন মহানবী (সা.)-এর সময়কালের অসংখ্য সজীব স্মৃতির বিবরণ এবং ধারাবাহিক বর্ণনা থেকে। তবে সব বর্ণনাই তাঁর কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু সেসব যাচাই করারও অবস্থা তাঁর ছিল না। সে কারণে বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় তিনি বর্ণনাকারীর নাম-পরিচয় উল্লেখসহ ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরার পাশাপাশি মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন, ‘এ বিষয়ে আল্লাহ্ সবচেয়ে ভাল জানেন।’

আরও পড়ুন

ইবনে ইসহাকের মূল পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে গিয়েছিল। একটি ভাষ্য হলো, খলিফা মনসুর এটি রেখে দিয়েছিলেন। তবে বিচ্ছিন্নভাবে অন্তত দুটো অনুলিপি ইবনে ইসহাকের এক ছাত্র আল বাক্কাইর কাছে ছিল। সেই অনুলিপির একটি পরবর্তীকালে সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করেন ইবনে হিশাম। সেই সম্পাদিত বইটির নাম আস-সিরাতুন নববিয়াহ। অষ্টম শতকে সেটি প্রকাশিহ হয়। তবে সেটি সিরাতে ইবনে হিশাম নামেই জনপ্রিয় হয়েছে। বস্তুত এটি ইবনে ইসহাক রচিত সিরাতের সংক্ষিপ্ত রূপ। ইবনে হিশাম মূল বইয়ের অনেক কিছু বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তিনি বেশ কিছু টিকা-টিপ্পনীও যোগ করেছিলেন। এখন ইবনে ইসহাকের সিরাত হিসেবে যেটি পাওয়া যায়, তা ইবনে হিশামের সম্পাদিত রূপ।

আরবী থেকে ১৮৬৪ সালে জার্মান ভাষায় প্রথম এর অনুবাদ বের হয়। হাইডেলবার্গের অধ্যাপক গুস্তাভ ওয়েলি অনুবাদটি করেন। কয়েক দশক পরে হাঙ্গেরীয় পণ্ডিত এডওয়ার্ড রেচাৎসেক এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন। তবে ১৯৫৫ সালে আলফ্রেড গিয়োম আরবি থেকে ইংরেজিতে যে অনুবাদটি করেন, তা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি অনুবাদ। আর গিয়োমের ইংরেজি অবলম্বনে বাংলায় এটি রূপান্তর করেন শহীদ আখন্দ। ঢাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৯৮৭ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব এক খণ্ডে আর ১৯৯২ সালে তৃতীয় পর্ব আরেক খণ্ডে প্রকাশ করে। ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশন পুরোটা এক খণ্ডে পরিমার্জিতভাবে প্রকাশ করে।

আরও পড়ুন

প্রথম পর্বে মহানবী (সা.)-এর বংশানুক্রম, ইসলাম-পূর্ব সময় থেকে ঐতিহ্য-বিবরণ, মহানবী (সা.)-এর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে পাঠক নবুয়াত ও মক্কায় ধর্মপ্রচারের কাহিনী জানতে পারবেন। আর তৃতীয় বা শেষ পর্বে মহানবী (সা.)-এর মদিনায় হিজরত, যুদ্ধ, বিজয় এবং ইন্তেকালের বর্ণনা রয়েছে।

তবে শহীদ আখন্দ বাংলা অনুবাদে গিয়োমের ইংরেজি অনুবাদের সুদীর্ঘ ভূমিকাটি ঠাঁই দেননি। একইভাবে বাদ পড়েছে ইবনে হিশামের টীকাগুলো, সম্ভবত কলেবর বৃদ্ধি কিংবা কিছু অনভিপ্রেত বির্তক এড়াতে।

 সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.): মহানবীর প্রথম বিশদ জীবনী. ইবনে ইসহাক, অনুবাদ: শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৭, ১৫০০ টাকা

আরও পড়ুন