অপরাধবোধ যখন পবিত্র হয়ে ওঠে
গাজা, সুদান কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে যখন গণহত্যা, ক্ষুধা, অনাহার আর মৃত্যুর বিভীষিকা আমাদের চোখের সামনে আসে, তখন বুকের ভেতর একটা মোচড় দেওয়া অনুভূতি বা অপরাধবোধের জন্ম নেয়। এই অনুভূতি আমরা সবাই কমবেশি অনুভব করি। এটি এক ভারী বোঝা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক রুটিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
মিটিং, খাবারের বিরতি বা আরামদায়ক বিছানার ফাঁকে ফাঁকে যখন সেই অকল্পনীয় ছবিগুলো আমাদের ফোন স্ক্রিনে ভেসে ওঠে, তখন একটি প্রশ্ন বারবার আমাদের মনকে দংশন করে, ‘আমি কেমন মুসলমান যে আমার ভাইবোনেরা যখন ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে আছে, তখন আমি আরামে বসে আছি?’
আজ আমরা এই অপরাধবোধ নিয়েই আলোচনা করব। একে দূর করার জন্য নয়, বরং এর গুরুত্ব বোঝার জন্য। এই অপরাধবোধ সম্ভবত আপনার জীবনে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক সংকেতগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আপনি যে অপরাধবোধ অনুভব করছেন, তা আপনার আধ্যাত্মিক সিস্টেমের কোনো ত্রুটি বা ব্যর্থতা নয়। এটি আপনার আধ্যাত্মিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, যা আল্লাহর নকশা অনুযায়ী কাজ করছে।
যে অপরাধবোধ থেকে আমরা পালাতে চাই
মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো অস্বস্তি বা মানসিক কষ্ট থেকে পালিয়ে বেড়ানো। গাজা বা অন্যান্য নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য যখন আমাদের মনে অপরাধবোধ জন্ম নেয়, তখন আমরা প্রায়শই এটিকে যুক্তি দিয়ে সরিয়ে দিতে চাই:
‘আমি একা আর কী করতে পারি? আমি তো কেবলই একজন ব্যক্তি।’
‘সরকারগুলোর কাজ করা উচিত, আমার মতো সাধারণ মানুষের নয়।’
‘আমি তো ইতিমধ্যেই অনুদান দিয়েছি, পোস্ট শেয়ার করেছি এবং দোয়া করেছি। এর চেয়ে বেশি আর কী করা যায়?’
আমরা মূলত এমন পথ খুঁজি, যা এই মানসিক বোঝাটিকে হালকা করে দেবে, যেন আমরা সেই তীব্র ব্যথা ছাড়া আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি। কিন্তু কেমন হয়, যদি আমরা এই অপরাধবোধকে নির্মূল করার চেষ্টা না করে, এটিকে আমাদের হৃদয়ের এবং সমগ্র উম্মতের পরিবর্তনের জন্য এক স্ফুলিঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করি?
অপরাধবোধই মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত রাখে
নবীজি ঘোষণা করেছেন, ‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতিতে মুমিনগণ এক দেহের মতো। যখন দেহের কোনো অঙ্গ কষ্ট পায়, তখন পুরো শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে তার প্রতি সাড়া দেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০১১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৮৬)
আপনি যে অপরাধবোধ অনুভব করছেন, তা আপনার আধ্যাত্মিক সিস্টেমের কোনো ত্রুটি বা ব্যর্থতা নয়। এটি আপনার আধ্যাত্মিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, যা আল্লাহর নকশা অনুযায়ী কাজ করছে। যখন আপনার শরীর আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন ব্যথার সংকেত মস্তিষ্ককে সতর্ক করে যে কোথাও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
একইভাবে যখন মুসলিম জনগোষ্ঠীর কোনো অংশ কষ্ট পায়, তখন আপনার ভেতরের সেই আধ্যাত্মিক অস্বস্তি প্রমাণ করে যে আপনার আত্মা বিশ্বাসীদের এই বৃহত্তর শরীরের ক্ষতের কথা বুঝতে পারছে।
যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা করে না, সে তাদের দলভুক্ত নয়।
এই অপরাধবোধ আসলে স্বাস্থ্যকর ইমানের লক্ষণ। এর অর্থ হলো আপনার হৃদয় এখনো বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত। এর অর্থ হলো আপনি অন্যের কষ্টে আধ্যাত্মিকভাবে অসাড় বা অনুভূতিহীন হয়ে যাননি।
নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা করে না, সে তাদের দলভুক্ত নয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৬৪৭)
আপনার এই অপরাধবোধ প্রমাণ করে, আপনি যত্নশীল। একে দূরে ঠেলে দেবেন না, বরং এটিকে একটি সঠিক পথে চালিত করুন।
অপরাধবোধ থেকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে
আমাদের হৃদয়ের এই পবিত্র বেদনা বা অপরাধবোধকে অব্যবহৃত রেখে দেওয়া উচিত নয়। এটি আমাদের নিম্নলিখিত তাৎক্ষণিক পদক্ষেপগুলো নিতে চালিত করবে:
নিয়মিত অনুদান দিন: আবেগপ্রবণ হয়ে এককালীন বড় অনুদান দেওয়ার পরিবর্তে, একটি টেকসই এবং ধারাবাহিক সাপ্তাহিক বা মাসিক অনুদানের ব্যবস্থা করুন। এ ধরনের নিয়মিত অনুদান আপনার দায়িত্বশীলতাকে দীর্ঘস্থায়ী করে। নিশ্চিত করুন যে আপনি বিশ্বস্ত ও স্বীকৃত দাতব্য সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সাহায্য পাঠাচ্ছেন।
তথ্য দিয়ে আওয়াজ তুলুন: কেবল ভয়াবহতাগুলোই নয়, বরং বর্তমান পরিস্থিতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক কারণগুলো সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদের শিক্ষিত করুন। জ্ঞানভিত্তিক প্রচারণা দীর্ঘমেয়াদি জনমত গঠনে সহায়তা করে। (ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি, আদ-দাওলা আল-উসমানিয়্যা ওয়া হাকিকাতুল উলুম, ১/পৃ. ৬৪, দার ইবনে আল-জাওজি, মিসর, ২০০৭)
দোয়া করুন: আপনার দৈনিক নামাজে, বিশেষ করে সিজদায় বা তাহাজ্জুদের সময়, নিবিড়ভাবে গাজার ভাইবোনদের জন্য দোয়া করার জন্য সুনির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করুন। দোয়া হলো মুমিনের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। দোয়া শুধু সান্ত্বনা নয়, এটি ভাগ্যের (তাকদির) পরিবর্তনকারী শক্তি নিয়ে আসার একটি উপায়।
অপরাধবোধ থেকে দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তর
আপনি সবচেয়ে গভীর যে কাজটি করতে পারেন, তা হলো এই অপরাধবোধকে শুধু গাজার জন্য নয়, বরং আমাদের সমগ্র মুসলিম জাতির দীর্ঘমেয়াদি শক্তির জন্য একজন উন্নত মুসলিম হিসেবে আপনাকে রূপান্তরিত করতে দেওয়া।
গাজার কষ্ট নিয়ে আপনার অস্বস্তি আপনার নিজের মধ্যে আল্লাহর সঙ্গে আপনার সম্পর্ককে জোরদার করার দিকে চালিত করা উচিত।
এই অপরাধবোধকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করুন: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে আদায় করুন, তাহাজ্জুদকে অভ্যাসে পরিণত করুন, নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে কোরআন মুখস্থ করুন এবং ইসলামি জ্ঞানকে গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করুন। আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী প্রতিটি মুসলিম আমাদের সামষ্টিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে।
এই সংকট আরও একটি বিষয় উন্মোচন করেছে: আমরা মানসিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে কতটা পরাধীন হয়ে পড়েছি। আমাদের নিজেদের দুর্ভোগ মেটানোর জন্য আমরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই এই অপরাধবোধকে সভ্যতাকেন্দ্রিক চেতনার দিকে চালিত করুন।
শুরুটা সহজ হতে পারে, যেমন কোরআন বোঝার জন্য আরবি ভাষা শেখা বা হিজরি বর্ষপঞ্জিকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। এগুলো কেবল প্রতীকী কাজ নয়, এটি আপনার মানসিক কাঠামোকে একটি ইসলামি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির দিকে আবার তার দিয়ে জোড়ার প্রক্রিয়া।
নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘আজ আমি কোন বীজ রোপণ করতে পারি, যা আগামী ১০, ২০ বা ৫০ বছরে মুসলিমদের উপকারে আসবে?’
হয়তো সেটি হতে পারে:
যে বইটি লিখতে আপনি ভাবছিলেন, তা শুরু করা।
একটি হালাল কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা।
আপনার সন্তানদের এমন আত্মবিশ্বাসী, সক্ষম মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা, যারা উম্মাহর সেবা করবে।
বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজে অবদান রাখার মতো বিশেষ দক্ষতা অর্জন করা।
আপনার অপরাধবোধ যেন আপনাকে পঙ্গু বা হতাশ না করে তোলে। এটি বরং আপনাকে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি—উভয় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের বীজ রোপণ করতে চালিত করবে।
সাধারণ অপরাধবোধ আমাদের পঙ্গু করে বা হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। পবিত্র অপরাধবোধ আমাদের কর্মের দিকে শক্তি জোগায়।
যখন অপরাধবোধ পবিত্র হয়ে ওঠে
সাধারণ অপরাধবোধ এবং পবিত্র অপরাধবোধের মধ্যে পার্থক্য হলো এর দিকনির্দেশনায়। সাধারণ অপরাধবোধ ভেতরের দিকে ঘুরে যায়, যা আমাদের অসহায় এবং অযোগ্য মনে করায়।
অন্যদিকে পবিত্র অপরাধবোধ বাইরের দিকে এবং ওপরের দিকে—আল্লাহ ও সেবার দিকে পরিচালিত হয়। সাধারণ অপরাধবোধ আমাদের পঙ্গু করে বা হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। পবিত্র অপরাধবোধ আমাদের কর্মের দিকে শক্তি জোগায়।
পবিত্র অপরাধবোধ প্রশ্ন করে: ‘আমি যে ব্যথা অনুভব করছি, তা কীভাবে কোনো উপকারী জিনিসে রূপান্তরিত হতে পারে?’
চাই না যে আপনার অপরাধবোধ উধাও হয়ে যাক, যাতে আপনি রাতে আরামে ঘুমাতে পারেন। বরং পরামর্শ দিচ্ছি, এই পবিত্র অপরাধবোধকে সঙ্গে নিয়ে থাকুন এবং এটিকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তরের জন্য একটি অনুঘটক হতে দিন।
আজ আপনি যে অপরাধবোধ অনুভব করছেন, তা আপনার আত্মার এই বার্তা, ‘আমি নিজের চেয়েও বৃহত্তর কিছুর সঙ্গে যুক্ত। আমি এক উম্মাহর অংশ। তাদের যা হয়, আমারও তা হয়।’
এই অনুভূতিকে অসাড় করবেন না। এই দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাবেন না। বরং একে শক্তিতে রূপান্তর করে এমন একজন মুসলিম হোন, যিনি শক্তি, প্রজ্ঞা এবং অর্থবহ কর্মের মাধ্যমে এমন সংকটময় মুহূর্তগুলো মোকাবিলা করতে পারেন।
আপনার আজকের অপরাধবোধই হতে পারে সেই আধ্যাত্মিক জ্বালানি, যা কেবল আপনার নিজের জীবনকে পরিবর্তন করবে না, বরং আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিজয় ও মর্যাদায় অবদান রাখবে, ইনশা আল্লাহ।