ইয়াকিন হলো ইমানের সর্বোচ্চ স্তর এবং প্রতিটি মুমিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি শুধু একটি নিছক জ্ঞান নয়, বরং হৃদয়ের সেই গভীর স্থিরতা ও পরম প্রশান্তি, যা ইমানের মধ্যে দেহের জন্য আত্মার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থান রাখে।
ইয়াকিনের মাধ্যমেই আল্লাহকে জানার ক্ষেত্রে পণ্ডিত ব্যক্তিরা ভিন্ন ভিন্ন স্তরে উপনীত হন এবং সৎকর্মশীলেরা একে অপরের চেয়ে এগিয়ে যান। (ইবনুল কাইয়্যিম, মাদারিজুস সালিকিন, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩৯৭)
এই প্রবন্ধে আমরা ইয়াকিনের অর্থ, তার মৌলিক স্বরূপ, কোরআন ও সুন্নাহতে তার গুরুত্ব এবং তা অর্জনের বাস্তব উপায়গুলো আলোচনা করব।
আরবিতে ‘ইয়াকিন’ শব্দের মূল অর্থ হলো নিশ্চিত জ্ঞান, সন্দেহ দূর করা এবং কোনো বিষয়কে প্রমাণ সাপেক্ষে সত্য বলে নিশ্চিত করা।
ইয়াকিন: শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
আরবিতে ‘ইয়াকিন’ শব্দের মূল অর্থ হলো নিশ্চিত জ্ঞান, সন্দেহ দূর করা এবং কোনো বিষয়কে প্রমাণ সাপেক্ষে সত্য বলে নিশ্চিত করা। এটি সন্দেহের বিপরীত এবং জ্ঞানের বিপরীত হলো অজ্ঞানতা। (লিসানুল আরব, খণ্ড: ১৫, পৃষ্ঠা: ৪৫৪)
শরিয়তের দৃষ্টিতে ইয়াকিন হলো হৃদয়ে জ্ঞানের স্থিরতা ও প্রজ্ঞার স্থায়িত্ব।
বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জুনায়েদ (রহ.) বলেন, ‘ইয়াকিন হলো হৃদয়ে এমনভাবে জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা, যা আর কখনো স্থানচ্যুত হয় না, পরিবর্তন হয় না বা দূরীভূত হয় না।’ (আল-কুশাইরি, আর-রিসালাহ আল-কুশাইরিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৩১৯)
অন্যভাবে বলা যায়, ইয়াকিন মানে দৃঢ়, অপরিবর্তনশীল ও নিশ্চিত বিশ্বাস, যা মনকে কোনো দ্বিধা, সন্দেহ বা অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে দেয়। এর মূল সেই জ্ঞান, যা হৃদয়কে সন্দেহ ও অস্থিরতার হাত থেকে রক্ষা করে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর মতে, ইয়াকিন ইমানের এমন একটি অংশ, যা দেহের জন্য আত্মার মতো। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৫৭০)
ইমানে ইয়াকিনের মর্যাদা
ইয়াকিন হলো ইমানের সর্বোচ্চ স্তরগুলোর একটি, যা ছাড়া জান্নাত লাভ করা যায় না এবং এর মাধ্যমেই আল্লাহর পথে থাকা সম্ভব হয়।
হাসান বাসরি (রহ.) বলেন, ‘ইয়াকিন ছাড়া জান্নাত তালাশ করা হয় না, ইয়াকিন ছাড়া জাহান্নাম থেকে পালানো যায় না, ইয়াকিন ছাড়া ফরজগুলো পালন করা হয় না এবং ইয়াকিন ছাড়া সত্যের ওপর ধৈর্য ধারণ করা যায় না।’ (ইবনে আবিদ দুনিয়া, আল-ইয়াকিন, পৃষ্ঠা: ১০২)
ইয়াকিন তখনই অর্জিত হয়, যখন সেই নিশ্চিত জ্ঞান হৃদয়কে সব ধরনের অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে এবং বান্দাকে এই বোধ দেয় যে আল্লাহ তাকে দেখছেন।
ইবনে তাইমিয়া ব্যাখ্যা করেছেন যে ইয়াকিন দুটি দিককে সমন্বিত করে:
১. হৃদয়ের জ্ঞান: একে বলে ‘ইলম আল-ক্বালব’। কোনো বিষয়ে নিশ্চিত ও সন্দেহমুক্ত জ্ঞান থাকা।
২. হৃদয়ের কর্ম: একে বলে ‘আমাল আল-ক্বালব’ সেই জ্ঞান অনুযায়ী হৃদয় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে কাজে উদ্বুদ্ধ করা। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৩২৯)
যদি কোনো ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে জানে যে আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তার হৃদয়ে সেই জ্ঞানের ফলে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসা ও স্থিরতা জন্ম না নেয়, তবে তার জ্ঞান ইয়াকিনের স্তরে পৌঁছায়নি।
ইয়াকিন তখনই অর্জিত হয়, যখন সেই নিশ্চিত জ্ঞান হৃদয়কে সব ধরনের অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে এবং বান্দাকে এই বোধ দেয় যে আল্লাহ তাকে দেখছেন, ফলে সে তার ইবাদতে মনোযোগী হয়।
এই ইয়াকিনের পূর্ণতা তখনই আসে, যখন বান্দা আখিরাতের বিষয়গুলো—যেমন পুনরুত্থান, হিসাব-নিকাশ, পুলসিরাত এবং প্রতিদান—এমনভাবে বিশ্বাস করে যেন সে তা চক্ষু দিয়ে দেখছে। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘এবং আখিরাতে তারা দৃঢ়বিশ্বাস রাখে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৪)
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘ধৈর্য ও ইয়াকিন একত্রে মিলিত হলে ইসলামের ক্ষেত্রে ইমামত (নেতৃত্ব) অর্জিত হয়।’ (মাদারিজুস সালিকিন, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩৯৭)