শিক্ষা নিয়ে ইবনে খালদুনের ভাবনা

ইবনে খালদুন রচিত ‘মুকাদ্দিমা’র একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপির পাতাছবি: উইকিপিডিয়া

শিক্ষা কেবল বইয়ের পাতা ওলটানো নয়; বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে আলো ছড়ানোর এক অমূল্য হাতিয়ার। কোরআন বলেছে, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? নিশ্চয় শুধু বিবেকবানেরাই এতে চিন্তা করে।’ (সুরা যুমার, আয়াত: ৯)

আবার বলেছে, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা দান করবেন।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত: ১১)।

মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যাকে আল্লাহ কল্যাণকর করতে চান, তাকে ইসলামের জ্ঞান দান করেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪) এবং ‘জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)

ইসলামের প্রথম দিন থেকে এ আহ্বান বাস্তবায়িত হয়েছে। বদরের যুদ্ধের বন্দীদের মুক্তির শর্ত ছিল, মুসলিম শিশুদের শিক্ষা দেওয়া। ইসলামি ইতিহাসে ইবনে সিনা, গাজালি ও ইবনে খালদুনের মতো মহান চিন্তাবিদেরা শিক্ষার তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তুলেছেন।

খালদুন ছাত্রকে একসঙ্গে দুটি বিষয় শেখানোর বিরোধিতা করেছেন। কারণ, এতে মন বিভ্রান্ত হয়। শিক্ষণের তিনবার পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন। এই পদ্ধতিকে ‘উপকারী শিক্ষণ’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।

ইবনে খালদুন (৭৩২-৮০৮ হিজরি/১৩৩২-১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর মুকাদ্দিমায় শিক্ষাকে সমাজের উন্নয়নের চালিকা শক্তি মনে করেছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষা মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজন, যা সভ্যতার সঙ্গে বিকশিত হয়। তাঁর মতে, শিক্ষা কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়; বরং মনের বিকাশ ও সমাজের ঐক্যের মাধ্যম।

আজকের দুনিয়ায় যেখানে শিক্ষা প্রায়ই বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে, ইবনে খালদুনের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে শিক্ষা হলো মানুষের মুক্তির পথ।

আরও পড়ুন
যেখানে ইবনে খালদুন জন্মগ্রহণ করেছেন। তিউনিস, তিউনিসিয়া
ছবি: উইকিপিডিয়া

জ্ঞানের সারাংশ: মনের বিকাশের চাবি

ইবনে খালদুন মুকাদ্দিমার ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘জ্ঞানের ধরন, শিক্ষণের পদ্ধতি এবং তার বিভিন্ন দিক’ শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, জ্ঞান হলো মনের এমন একটি অর্জন, যা আগে ছিল না। এ অর্জনগুলো স্বভাবতই হয়ে যায় না; বরং অর্জনটা করতে হয়।

মন সর্বদা চঞ্চল—জীবন, মৃত্যু ও পরকাল নিয়ে চিন্তা করে। এ চিন্তা থেকে জ্ঞান ও শিল্পের জন্ম হয়। জ্ঞানের সূচনা হলো ইন্দ্রিয়ানুভূতি। তারপর জ্ঞান, যা বিকশিত হয়ে পূর্ণ জ্ঞান হয়।

ইবনে খালদুন জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন—প্রাকৃতিক (মনের চিন্তা থেকে উদ্ভূত, যেমন দর্শন) ও স্থানান্তরিত (অন্যের থেকে গৃহীত, যেমন ধর্মীয় জ্ঞান)। ধর্মীয় জ্ঞানে মনের স্বাধীনতা নেই, এটি শরিয়তের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।

অর্থাৎ, জ্ঞান কেবল তথ্যের সমাহার নয়; বরং মনের বিকাশ। আজকের শিক্ষায় যেখানে রটনমুখী পদ্ধতি প্রচলিত, ইবনে খালদুনের এ দৃষ্টিভঙ্গি চিন্তাশীল শিক্ষার পক্ষে যায়। কোনো শিক্ষার্থী যখন প্রথমবার কোরআনের আয়াত বুঝতে পারে, তার মনের দরজা খুলে যায়—এটিই জ্ঞানের সারাংশ।

তিনি সমকালীন শিক্ষকদের সমালোচনা করেছেন যে তাঁরা ছাত্রকে জটিল বিষয় দিয়ে শুরু করেন এবং শারীরিক শাস্তি দিয়ে পড়ান। তিনি বলেছেন, শারীরিক শাস্তি উদ্যম নষ্ট করে, মিথ্যা শেখায় ও ছলাকলা বাড়ায়।

শিক্ষণের উৎপত্তি ও বিকাশ: সভ্যতার সঙ্গে যাত্রা

ইবনে খালদুন বলেছেন, ‘জ্ঞান ও শিক্ষা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা।’ মানুষ সর্বদা অজানাকে জানতে চায় এবং অগ্রগামীদের কাছে শেখে। এ প্রয়োজন থেকে শিক্ষা জন্ম নেয়, যা সভ্যতার সঙ্গে বিকশিত হয়। শহরে বসবাসকারীরা প্রথমে খাদ্য-আবাসের চিন্তা করে, তারপর শিক্ষা ও শিল্পের দিকে মনোনিবেশ করে। বেদুইনরা জ্ঞানের জন্য শহরে যায় এবং বিখ্যাত শিক্ষকদের কাছে শেখে। কারণ, শিক্ষকেরা শিক্ষণের স্তম্ভ।

ইবনে খালদুন শিক্ষাকে ‘শিল্পের একটি অংশ’ বলেছেন, যা ‘ফিতরি’ (সৃষ্টিজাত স্বভাব নয়) নয়; বরং অর্জিত। ইসলামের প্রথম যুগে শিক্ষা ছিল সরাসরি শরিয়ত থেকে গ্রহণ, কিন্তু পরে ফিকহর বিকাশের সঙ্গে এটি জটিল হয়েছে। তিনি বলেছেন, ইসলামের প্রথম যুগ এবং দুই খিলাফতকালে শিক্ষা এমন ছিল না। জ্ঞান সাধারণত শরিয়ত থেকে গ্রহণ করা হতো এবং ধর্মের অজ্ঞতা দূর করা হতো।

ইসলামের বিস্তারের সঙ্গে নিয়মের প্রয়োজন হয়েছে, যা শিক্ষাকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পে পরিণত করেছে।

শিক্ষকদের পদ্ধতির বৈচিত্র্য তাঁর মতে শিক্ষার শিল্পময়তার প্রমাণ। প্রত্যেক ইমামের নিজস্ব পদ্ধতি ছিল, যা জ্ঞানের অংশ হলে একই হতো। এ বৈচিত্র্য আমাদের শেখায় শিক্ষা এককথায় বাঁধা নয়, এটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও প্রসঙ্গভিত্তিক। আজকের শিক্ষায় যেখানে একই পদ্ধতি সবার জন্য চাপানো হয়, ইবনে খালদুনের এ দৃষ্টি বৈচিত্র্যের পক্ষে যায়।

আরও পড়ুন
আমেরিকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে সংরিক্ষত ইবনে খালদুনের ব্রোঞ্জ নির্মিত প্রতিকৃতি
ছবি: উইকিপিডিয়া

শিক্ষণের পদ্ধতি: ধাপে ধাপে বিকাশ

ইবনে খালদুন বলেছেন, ছাত্রের মধ্যে ‘প্রস্তুতি’ থাকতে হবে, কিন্তু জ্ঞান একবারে আসে না। এটি ধাপে ধাপে আসে। তিনি তিন ধাপের পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন—প্রথমে মূলনীতি থেকে শুরু করে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া। দ্বিতীয়ত, সারাংশ ও বিস্তারিতের মধ্যবর্তী পথ। তৃতীয়ত, সম্পূর্ণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে।

খালদুন ছাত্রকে একসঙ্গে দুটি বিষয় শেখানোর বিরোধিতা করেছেন। কারণ, এতে মন বিভ্রান্ত হয়। শিক্ষণের তিনবার পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন—প্রথমে সারাংশ, দ্বিতীয়ত মধ্যম, তৃতীয়ত সম্পূর্ণ। এই পদ্ধতিকে ‘উপকারী শিক্ষণ’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।

তিনি সমকালীন শিক্ষকদের সমালোচনা করেছেন যে তাঁরা ছাত্রকে জটিল বিষয় দিয়ে শুরু করেন এবং শারীরিক শাস্তি দিয়ে পড়ান। তিনি বলেছেন, শারীরিক শাস্তি উদ্যম নষ্ট করে, মিথ্যা শেখায় ও ছলাকলা বাড়ায়। তিনি প্রস্তাব করেছেন শিক্ষকদের ওপর নজর রাখা, যাতে তাঁরা ছাত্রদের শাস্তি না দেন।

এই পদ্ধতি আজকের শিক্ষায় প্রাসঙ্গিক। ধাপে ধাপে শিক্ষা ও শারীরিক শাস্তির বিরোধিতা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়। শিক্ষক যখন ছাত্রকে ধৈর্যসহকারে বোঝান, ছাত্রের মন খুলে যায়—এটিই ইবনে খালদুনের ‘উপকারী শিক্ষণে’র অংশ।

খালদুন প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম ছিল—প্রথমে আরবি ও কবিতা। তারপর গণিত। এরপর কোরআন, ধর্মের মূলনীতি, ফিকহ, বিতর্ক ও হাদিস। আরবিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ, ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; তাই আরবি ভাষাটা প্রথমে শেখানো দরকার।

শিক্ষা পাঠ্যক্রম: ইবনে খালদুনের দৃষ্টিভঙ্গি

ইবনে খালদুন বিভিন্ন অঞ্চলের পাঠ্যক্রম বর্ণনা করেছেন এবং কাজি আবু বকর আল-আরাবির পাঠ্যক্রমকে সমর্থন করেছেন। মাগরেবে (মরক্কো, তিউনিসিয়া) কোরআন প্রথমে, তারপর আরবি ও লিপি। আন্দালুসে কোরআনের সঙ্গে কবিতা, আরবি ও লিপি। আফ্রিকায় কোরআনের সঙ্গে হাদিস, তারপর বিজ্ঞানের মূলনীতি। মিসরে কোরআনের সঙ্গে বিজ্ঞানের মূলনীতি, লিপি পরে।

খালদুন প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম ছিল—প্রথমে আরবি ও কবিতা। তারপর গণিত। এরপর কোরআন, ধর্মের মূলনীতি, ফিকহ, বিতর্ক ও হাদিস। আরবিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ, ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; তাই আরবি ভাষাটা প্রথমে শেখানো দরকার, যাতে ছাত্র পরবর্তী জ্ঞান বুঝতে পারে।

এ পাঠ্যক্রম আজকের শিক্ষায় প্রাসঙ্গিক—ভাষা ও গণিতের ভিত্তি গড়ে তারপর ধর্মীয় জ্ঞান। ইবনে খালদুনের এ দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষাকে ব্যবহারিক করে তুলেছে।

ইবনে খালদুন শিক্ষাকে সমাজের আয়না মনে করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে জ্ঞান মনের বিকাশ, শিক্ষা স্বাভাবিক প্রয়োজন, পদ্ধতি ধাপে ধাপে এবং পাঠ্যক্রম ভাষাকেন্দ্রিক। আজকের শিক্ষায় যেখানে কেবল বর্ণনা ও শাস্তি প্রচলিত, তাঁর চিন্তা বিকল্প পথ দেখায়। ইসলামের আলোয় শিক্ষা কেবল জ্ঞান নয়; বরং চরিত্র গঠন। আল্লাহ আমাদের ইবনে খালদুনের মতো চিন্তাবিদদের অনুসরণের তাওফিক দিন। আমিন।

সূত্র: মুকাদ্দিমা, ইবনে খালদুন, মাকতাবায়ে শামেলা লাইব্রেরি

আরও পড়ুন