ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক সাহাবি আছেন, যারা নীরবে-নিভৃতে ইসলামের জন্য অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তাঁরা জিহাদ ও দাওয়াতের অঙ্গনে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁদের আলোচনা প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়।
এমনই একজন মহান সাহাবি হলেন রুওয়াইফা বিন সাবিত আনসারি (রা.)। তিনি ছিলেন একাধারে মুজাহিদ, দক্ষ প্রশাসক, দূরদর্শী দাঈ ও ফকিহ। তিউনিসিয়ার জারবা দ্বীপ জয়ের নায়ক রুওয়াইফা তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ইসলামের সেবায় এবং জিহাদে অবদান রেখে শাহাদতের মর্যাদা লাভ করেছেন।
তিনি রাজনৈতিক বিরোধ থেকে নিজেকে সর্বদা দূরে রাখতেন এবং ইসলামের শান্তিপূর্ণ দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে অটল ছিলেন।
তিনি ছিলেন একাধারে মুজাহিদ, দক্ষ প্রশাসক, দূরদর্শী দাঈ ও ফকিহ। তিউনিসিয়ার জারবা দ্বীপ জয়ের নায়ক রুওয়াইফা তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ইসলামের সেবায়।
নাম ও বংশপরিচয়
রুওয়াইফা বিন সাবিত বিন সাকান বিন আদি বিন হারিসা আনসারি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের মালিক বিন নাজ্জার বংশের একজন সদস্য। তিনি রাসুল (সা.)-এর সান্নিধ্যে ধন্য হয়েছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে আটটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা পরবর্তীতে কয়েকজন তাবেয়ি বর্ণনা করেছেন।
তিনি ছিলেন ফাতওয়া প্রদানকারী সাহাবিদের একজন, যাঁদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইসলামি বিধানের ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা, ২/১৫৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৫)
তবে তাঁর ইসলাম গ্রহণের সঠিক সময় সম্পর্কে ঐতিহাসিক সূত্রে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। এটি স্পষ্ট যে, তিনি রাসুল (সা.)-এর সহবতপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান সাহাবিদের একজন ছিলেন, যদিও রাসুল (সা.)-এর নেতৃত্বে সরাসরি জিহাদে অংশগ্রহণের সুযোগ তিনি পাননি। (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা, ২/১৫৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৫)
জিহাদে অবদান
রুওয়াইফা (রা.)-এর জীবন ছিল জিহাদ ও দাওয়াতের এক অপূর্ব সমন্বয়। তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর শাম ভূখণ্ড এবং উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। শাম মুসলিমদের হাতে আসার পর তিনি আমর ইবনুল আস (রা.)-এর নেতৃত্বে মিসর, লিবিয়া, নুবা ও মরক্কো বিজয়ে অংশ নেন। (আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি, আল-ফাতহুল ইসলামি ফি শিমালিল আফরিকি, পৃ. ২০৮, দারুল মা’রিফা, কায়রো, ২০০৫)
এছাড়া, তিনি মুয়াবিয়া বিন হুদাইজ সাকুনি এবং আবদুল্লাহ বিন আবিস সারহের সঙ্গে মরক্কো ও আফ্রিকা বিজয়ের বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
৪৫ হিজরিতে মুয়াবিয়া বিন হুদাইজ সাকুনি মাগরিবে পশ্চিম ত্রিপোলি পুনরুদ্ধার করেন। এই বিজয়ের পর ৪৬ হিজরিতে রুওয়াইফাকে ত্রিপোলির প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। (আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি, আল-ফাতহুল ইসলামি ফি শিমালিল আফরিকি, পৃ. ২০৯, দারুল মা’রিফা, কায়রো, ২০০৫)
৪৭ হিজরিতে তিনি তিউনিসিয়ায় আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং জারবা দ্বীপ জয় করেন। এই দ্বীপে তিনি বার্বারদের মধ্যে ইসলামের শান্তিপূর্ণ দাওয়াত ছড়িয়ে দেন এবং স্থানীয়দের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। (আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি, আল-ফাতহুল ইসলামি ফি শিমালিল আফরিকি, পৃ. ২১০, দারুল মা’রিফা, কায়রো, ২০০৫)
একই বছর তিনি ত্রিপোলিতে তাঁর মূল কর্মস্থলে ফিরে আসেন।
র প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর শাম ভূখণ্ড এবং উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তিনি আমর ইবনুল আস (রা.)-এর নেতৃত্বে মিসর, লিবিয়া, নুবা ও মরক্কো বিজয়ে অংশ নেন।
জীবনযাপন ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা
রুওয়াইফা (রা.) ছিলেন একজন বড় মাপের সাহাবি। তিনি হজরত আলি (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে সংঘটিত রাজনৈতিক বিরোধে কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নেননি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সময় তিনি মিসরে অবস্থান করেন এবং সেখানে বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা, ২/১৫৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৫)
ফিতনার ঘোর কেটে গেলে এবং মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ফিরে এলে, তিনি শান্ত-চিত্তে ইসলামের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। শেষ জীবনে তিনি মাসলামা ইবনে মাখলাদের পক্ষ থেকে বারকা অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর কবর লিবিয়ার বায়দা শহরের বারকা নামক সবুজ পাহাড়ে অবস্থিত, যেখানে তিনি সাহাবিদের মধ্যে সর্বশেষ ইন্তেকাল করেন। (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা, ২/১৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৫)
নেতৃত্বগুণ ও যুদ্ধনীতি
রুওয়াইফা (রা.) ছিলেন একজন সুসংগঠিত, কঠোর কিন্তু ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক। তিনি ছিলেন শক্তিশালী, সত্যবাদী, বিশ্বস্ত, আল্লাহভীরু, উদার এবং দানশীল। তিনি শাম, মিসর ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আল্লাহর পথে জিহাদে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
তিনি বহু স্থল ও নৌ-যুদ্ধে অংশ নেন, বিশেষ করে সমুদ্রপথে তিউনিসিয়ার জারবা দ্বীপ জয়ে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তিনি দ্বীপের দুর্বৃত্তদের অপকর্ম সমূলে ধ্বংস করেন এবং ইসলামের শান্তিপূর্ণ দাওয়াত ছড়িয়ে দেন, বার্বার মুসলিমদের সঙ্গে স্থানীয়দের একীভূত করেন। (আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি, আল-ফাতহুল ইসলামি ফি শিমালিল আফরিকি, পৃ. ২১০, দারুল মা’রিফা, কায়রো, ২০০৫)
তাঁর যুদ্ধনীতির মূল শক্তি ছিল আল্লাহভীতি, তাঁর জিকির, তাওয়াক্কুল ও বিপদে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা। তিনি প্রজ্ঞার সঙ্গে তাঁর বাহিনী পরিচালনা করতেন, যেখানে পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল মূল ভিত্তি।
তিনি সতীর্থদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন এবং তাদের কল্যাণে সবকিছু করতেন। তাঁর নরম ও কোমল আচরণের মাধ্যমে তিনি সকল কাজ সম্পন্ন করতেন এবং কারও অধিকার বা পাওনা চুকাতে কোনো ত্রুটি করতেন না।
তিনি দ্বীপের দুর্বৃত্তদের অপকর্ম সমূলে ধ্বংস করেন এবং ইসলামের শান্তিপূর্ণ দাওয়াত ছড়িয়ে দেন, বার্বার মুসলিমদের সঙ্গে স্থানীয়দের একীভূত করেন।
ইতিহাসে অবদান
রুওয়াইফা (রা.) ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ মুজাহিদ, যিনি ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি শাম, মিসর ও আফ্রিকার ময়দানে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছেন, প্রশাসক হিসেবে দক্ষতা দেখিয়েছেন এবং দাঈ হিসেবে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর হাতে জারবা দ্বীপের বিজয় ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।
পরিবার-পরিজন ও প্রিয় মদিনা থেকে বহু মাইল দূরে, লিবিয়ার বারকায় সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর কবর আজও মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিদ্যমান।
মহান সাহাবি রুওয়াইফা বিন সাবিত আনসারি (রা.)-এর ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন। তাঁর জীবন আমাদের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যিনি ইসলামের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন এবং তাঁর প্রতিটি কাজে ইহসান ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছেন।