আবু জান্দাল (রা.)-এর আশ্চর্য ত্যাগ ও বিজয়

তাঁর নাম আস ইবনে সুহাইল, কিন্তু ইতিহাস তাঁকে চেনে আবু জান্দাল (রা.) নামে। তিনি প্রথম দিকেই গোপনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। তবে তা বেশি দিন গোপন থাকেনি, পিতা টের পেয়ে যান। পিতা ছিলেন মক্কার খ্যাতনামা নেতা সুহাইল ইবনে আমর।

নেতার ছেলে বিধর্মী হয়ে গেছে, এ তো চরম লজ্জার ব্যাপার। ফলে আবু জান্দালের ওপর শুরু হয় নিপীড়ন। শিকলবন্দি করে রাখা হয় তাঁকে। বলা হয়, প্রায় সাড়ে চার বছর তিনি এভাবে বন্দী ছিলেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/১৮০)

নেতার ছেলে বিধর্মী হয়ে গেছে, এ তো চরম লজ্জার ব্যাপার। ফলে আবু জান্দালের ওপর শুরু হয় নিপীড়ন।

তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে সুহাইল (রা.) বদরের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর হয়ে বের হলেও মুসলিম বাহিনীতে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আবু জান্দালের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি বদর যুদ্ধের আগেই জানাজানি হয়ে যায়। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ২/২৮১)

ষষ্ঠ হিজরিতে রাসুল (সা.) সহস্রাধিক সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে মক্কায় রওনা হন। প্রথমে গোয়েন্দা পাঠান কুরাইশদের খবর নিতে। জানা গেল, কুরাইশরা যুদ্ধের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং মুসলমানদের তারা মক্কায় ঢুকতে দেবে না। এ অবস্থায় নবীজি (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।

আরও পড়ুন

হুদায়বিয়া পৌঁছে নবীজি ওসমান (রা.)-কে কুরাইশদের কাছে এ বার্তা দিয়ে পাঠান যে আমাদের উদ্দেশ্য কেবল ওমরাহ পালন করা, যুদ্ধ নয়। কিন্তু কুরাইশরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। একপর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তিই ইসলামের ইতিহাসে হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। (সহিহ মুসলিম: ১,৭৮৪; সহিহ বুখারি: ২,৭৩১)

চুক্তিতে একটি শর্ত ছিল, ‘মক্কার কেউ ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় আশ্রয় চাইলে তাকে ফেরত দিতে হবে; তবে মদিনার কেউ ধর্ম ত্যাগ করে মক্কায় গেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম: ৩/৩২৮)

চুক্তিতে একটি শর্ত ছিল, ‘মক্কার কেউ ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় আশ্রয় চাইলে তাকে ফেরত দিতে হবে; তবে মদিনার কেউ ধর্ম ত্যাগ করে মক্কায় গেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।’

এই শর্ত মুসলমানদের জন্য ছিল বড় পরীক্ষা। চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার মুহূর্তে সাহাবি আবু জান্দাল (রা.) শিকলে বাঁধা অবস্থায় হাজির হন সেখানে। তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট। তিনি কাতর স্বরে বলেন, ‘তোমরা কি আমাকে আবার নিপীড়কদের হাতে তুলে দেবে?’

কুরাইশের প্রতিনিধি তখন তাঁরই পিতা সুহাইল ইবনে আমর। তিনি চুক্তিমতে আবু জান্দালকে ফেরত নিতে চাইলেন। নবীজি বললেন, ‘চুক্তি তো এখনো লেখা শেষ হয়নি।’ তবু সুহাইল রাজি হলেন না। নবীজি বলেন, ‘তাঁকে আমার খাতিরে ছেড়ে দাও।’ সুহাইল নাকচ করে দিলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ৩/৩৩৩)

আরও পড়ুন

এভাবেই সন্ধি চূড়ান্ত হয়ে যায়। সাহাবিদের হৃদয় ভেঙে যায়। অনেকে আবু জান্দালকে রক্ষা করতে চাইছিলেন।

সুহাইল তার ছেলে আবু জান্দালের মুখে চপেটাঘাত করে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। আবু জান্দাল তখনো চিৎকার করে তাঁকে রক্ষা করতে আহ্বান জানান। নবীজি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আবু জান্দাল, ধৈর্য ধরো এবং আল্লাহর পুরস্কার আশা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার ও তোমার মতো দুর্বল মুসলমানদের মুক্তির পথ তৈরি করবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৭৩১)

সন্ধির কিছুদিন পর আবু জান্দাল বন্দিদশা থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং মক্কার কাফেলার যাত্রাপথে আবাস গাড়েন।

সন্ধির কিছুদিন পর আবু জান্দাল বন্দিদশা থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং মক্কার কাফেলার যাত্রাপথে আবাস গাড়েন। সেখানে মক্কার পীড়িত সাহাবিদের আরও কয়েকজন জড়ো হন। তাঁরা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় হামলা চালাতে থাকেন।

একসময় মক্কার বণিকেরা অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরাই নবীজির কাছে অনুরোধ করলেন, সেই ‘শর্ত’টা বাতিল করার আবেদন করে বলেন, ‘তাদের মদিনায় আশ্রয় দিন, কেবল আমাদের কাফেলাগুলো রক্ষা করুন।’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/১৯৫)

এর কয়েক বছর পর মক্কা বিজয় হয়। বিজয়ের পর আবু জান্দালের বৃদ্ধ বাবা সুহাইল ইবনে আমর, যিনি একদিন ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তিনিও মুসলিম হন।

আরও পড়ুন