ইসলামের আলোকে শিশুর বিকাশে করণীয়

শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিও প্রয়োজন। সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য চাই চিত্তবিনোদন। খোলা মাঠ, মুক্ত আকাশ ও বিশুদ্ধ বাতাস শিশুর মনকে প্রফুল্ল করে। তাই মাঝেমধ্যে শিশুকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া–প্রতিবেশীদের সঙ্গে শিশুর পরিচয়, জানাশোনা, যোগাযোগ ও যাতায়াতের সুযোগ করে দিতে হবে। অভিভাবক ও বড়রা বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানে শিশুদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি শেখাতে হবে।
তারা ভুল করলে অপমান না করে, লজ্জা না দিয়ে শুধরে দিতে হবে। কারও সঙ্গে তুলনা করে শিশুকে হেয় করা যাবে না। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, তারা দেখে দেখে খুব দ্রুত আয়ত্ত করতে পারে। তাই শুধু কথায় নয়, কর্মে ও আচরণের মাধ্যমে তাদের সামনে উদাহরণ তৈরি করতে হবে।

শিশুর বিকাশের দুটি দিক, শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ। শিশুর শারীরিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির পাশাপাশি তার মানসিক বিকাশের দিকটায় গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক বৃদ্ধি মানে শিশুর দৈহিক উন্নতি ও সুস্থতা; আর মানসিক বিকাশ হচ্ছে শিশুর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, আচার-আচরণ, ভাষার প্রকাশ, বোধশক্তি, অনুভূতি, ভাবের আদান-প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়া। শিশুদের আদর–স্নেহ করা, তাদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, গল্প করা, খেলাধুলা করা; ছড়া, কবিতা ও গান শোনানো, তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা, আনন্দ দান ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটে। শিশুকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া, ভয় দেখানো, ধমক দেওয়া, রাগ করা বা অবহেলা করা হলে তার আবেগিক, সামাজিক ও মেধাগত দক্ষতার বিকাশ ব্যাহত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা সন্তানদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো এবং উত্তম আচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি)।

করোনায় পর্যুদস্ত এই সময়ে গৃহবন্দী শিশুরা তাদের জীবনের উচ্ছলতা ও স্বাভাবিক গতিময়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক শিশু হতাশা, অবসাদ ও নানা মনোবৈকল্যের শিকার হচ্ছে। অনেক শিশু নিরানন্দ একাকিত্বে বিভিন্ন গেমে আসক্ত হচ্ছে, অভিভাবকদের অসচেতনতায় অনেকে বিপথগামীও হচ্ছে এবং মাদককে সঙ্গী বানাচ্ছে। এমন জটিল পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে

দাদা-দাদি, নানা-নানি, ফুফু-খালা ও আপনজনদের সাহচর্য শিশুদের মানস গঠনে সহায়ক। বিশেষত পিতা-মাতা ও অভিভাবক তাদের সঙ্গ দিতে হবে। ইতিবাচক বায়নাগুলো সামর্থ্য অনুযায়ী পূরণের চেষ্টাও করতে হবে। প্রিয় নবী (সা.) শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিশু নাতি হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.)-এর সঙ্গে ঘোড়া ঘোড়া খেলতেন, তাঁরা নবীজি (সা.)-এর নামাজে সিজদার সময় ঘাড়ে-পিঠেও চড়ে বসতেন।

সৃজনশীল কাজে শিশুদের উৎসাহ দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাতের চেয়েও উত্তম।’ ‘তোমরা সন্তানদের জ্ঞান দান করো; কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি)। প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেবে, সাঁতার শিক্ষা দেবে এবং তিরন্দাজি ও অসি চালনা শিক্ষা দেবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। রাসুলে করিম (সা.) আরও বলেন, ‘শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। তোমরা তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে তা পূরণ করো। কেননা তাদের দৃষ্টিতে তোমরাই তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করছ।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

করোনায় পর্যুদস্ত এই সময়ে গৃহবন্দী শিশুরা তাদের জীবনের উচ্ছলতা ও স্বাভাবিক গতিময়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক শিশু হতাশা, অবসাদ ও নানা মনোবৈকল্যের শিকার হচ্ছে। অনেক শিশু নিরানন্দ একাকিত্বে বিভিন্ন গেমে আসক্ত হচ্ছে, অভিভাবকদের অসচেতনতায় অনেকে বিপথগামীও হচ্ছে এবং মাদককে সঙ্গী বানাচ্ছে। এমন জটিল পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। আমাদের সন্তানদের প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেণিগত লেখাপড়া নিয়মিত তদারকির পাশাপাশি তাদের গল্প, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা ও সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ক্যালিগ্রাফি, চিত্রাঙ্কন ও চারুকারু ইত্যাদি বিষয়ে এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জনে উৎসাহ দিতে হবে।

মানসিক প্রশান্তি, চারিত্রিক উন্নতি ও নৈতিক দৃঢ়তার নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী মাধ্যম হলো ধর্মশিক্ষা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই অখণ্ড অবসরে শিশুদের ধর্মশিক্ষা; তথা কোরআন শিক্ষা, কোরআন হিফজ করা, অর্থসহ কোরআন শিক্ষা, নামাজের দোয়া-দরুদ, সুরা-কিরাত মুখস্থ করা ও অর্থসহ শেখা এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী পাঠ অত্যন্ত সুফলদায়ক হবে, ইনশা আল্লাহ।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]