রবিউল আউয়ালের শিক্ষা সম্প্রীতির দীক্ষা

ইসলাম ধর্ম

সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। বনি আদম সবাই একই মা-বাবার সন্তান। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আল্লাহর আনুগত্য ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অনুসরণই একমাত্র পথ। পবিত্র মাহে রবিউল আউয়ালেই তাঁর আবির্ভাব। দীর্ঘ ১৩ বছর বহু জুলুম–নির্যাতন–নিপীড়ন সহ্য করে পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসেই তিনি পবিত্র মক্কা থেকে হিজরত করে পুণ্যভূমি মদিনায় শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসলাম সব মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা দেয়, দ্বন্দ্ব–সংঘাতকে সমর্থন করে না। তাই শান্তিদূত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিকসহ নানা ধর্মের ও নানা বর্ণের লোকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন; যা জাতি, ধর্ম ও বর্ণনির্বিশেষে সবার মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এটি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। এ চুক্তির উদ্দেশ্যাবলির অন্যতম ছিল যুদ্ধের পরিবর্তে পরস্পরের শান্তিপূর্ণ অবস্থান করা, অত্যাচারিত–নিপীড়িতকে সাহায্য করা এবং চুক্তিভুক্ত সব পক্ষের মানমর্যাদা ও ধর্মবিশ্বাসের অধিকার সংরক্ষণ করা।

মাহে রবিউল আউয়াল মদিনার সমাজে বসন্তের সুবাস বয়ে আনে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নৈরাজ্য, সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘাতের পরিবর্তে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন।

ইসলাম বহুজাতিক রাষ্ট্র ও সমন্বিত সমাজ প্রতিষ্ঠার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ঘোষণা করা হয়, ‘মুমিন মুসলিমগণ ও যারা তাদের অনুগামী হয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং তাদের সঙ্গে মিলে দেশের প্রতিরক্ষা করবে, তাদের মধ্যে তারা অভিন্ন একটি জাতি বলে পরিগণিত হবে এবং ন্যায়সংগত আচরণ করবে। কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে, কেউ জুলুমের থাবা বিস্তার করতে চাইলে, কেউ অন্যায় বা সীমা লঙ্ঘন করতে চাইলে ও বিপর্যয়–বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে সবাই সম্মিলিতভাবে তার প্রতিকার করবে, যদিও সে তাদের কারও সন্তানও হয়। কোনো মুমিন কারও পক্ষ নিয়ে কাউকে হত্যা করবেন না, আল্লাহর নিরাপত্তা জিম্মাদারি সবার জন্য সমান। অবশ্যই অঙ্গীকার পূর্ণ করতে হবে। যে কেউ আল্লাহ ও আখিরাতে ইমান এনেছে, তার জন্য কোনো চুক্তি ভঙ্গকারীকে সাহায্য করা বা আশ্রয় দেওয়া বৈধ নয়। যে এমন কাউকে সাহায্য করবে অথবা আশ্রয় দেবে, তার ওপর রোজ কিয়ামতে আল্লাহর লানত ও ক্রোধ নিপতিত হবে।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)–এর মহান আদর্শ হলো ‘যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করবে, সে ও তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জন্য দায়ী হবে। পিতার অপরাধে পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধে পিতাকে দায়ী করা যাবে না।’ ‘কেউ কারও পাপের বোঝা বহন করবে না।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৬৪ ও সুরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত: ১৫)। যদি কেউ মজলুম হয়, তাহলে সে নিজের প্রতিরক্ষা করতে পারবে। প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে, কোনো ব্যক্তি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না এবং মজলুমকে সবাই সাহায্য করবে। প্রতিবেশীকে নিজের মতোই গণ্য করতে হবে। তার কোনো ক্ষতি বা তার প্রতি কোনো অপরাধ সংঘটন করা যাবে না। কোনো জালিম বা অপরাধীকে সুরক্ষা দেওয়া যাবে না। যে জুলুম করবে এবং অপরাধ করবে, সে নিরাপদ নয়। যে ব্যক্তি এ চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্য করবেন। (ইবনে কাসির)।

শান্তির জন্য চাই সত্যনিষ্ঠা ও সংযম। বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ‘কেউ হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর অনুমোদন ব্যতিরেকে (রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ছাড়া) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হতে পারবে না।’ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.) সে ব্যক্তির সাহায্যকারী যে সত্যনিষ্ঠ ও সংযত।’ (সিরাতুন্নবী, ইবনে হিশাম)।

মহানবী (সা.) অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করে রবিউল আউয়াল মাসেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। দ্বন্দ্ব–সংঘাত এড়িয়ে সন্ধিতে আবদ্ধ হওয়া, প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা তাঁর শান্তিকামিতার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ এবং মাহে রবিউল আউয়ালের অন্যতম প্রধান শিক্ষা। তিনি শান্তি স্থাপনের জন্য মদিনা সনদ ছাড়াও হুদাইবিয়ার সন্ধিসহ আরও বহু সন্ধিতে আবদ্ধ হয়েছেন। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা জীবন এ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা মন্দকে ভালোর দ্বারা প্রতিহত করো’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৬৪)। ‘ভালো ও মন্দ সমান নয়, তোমরা মন্দকে উৎকৃষ্ট আচরণ দ্বারা প্রতিহত করো। ফলে তোমার জানের দুশমন, প্রাণের বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাবে।’ (সুরা-৪১ হা–মিম সিজদা, আয়াত: ৩৪)।

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    [email protected]