রবিউস সানি মাসের তাৎপর্য ও করণীয়

মহামহিম রাব্বুল আলামিনের অসীম কুদরতের প্রকাশ সময় বা কাল। সময় অনাদি অনন্ত। কালচক্রের ঘূর্ণন নিরন্তর, অবিরত। মানবজীবনে আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতসমূহের মধ্যে প্রথম নিয়ামত হলো জীবন। ইহজগতে জীবনের স্থিতিকাল হলো আয়ু। আয়ু সময়ের সমষ্টি। তাই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে সময় বা কালের শপথ করেছেন। (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১)।

সময়ের প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। বিষয়, বস্তু, ব্যক্তি ও স্থানের সঙ্গে সংযুক্ত করে সময়কে বিশেষ পরিচয়ে বিশেষায়িত বা সংজ্ঞায়িত করা হয়। ব্যবহারিক সুবিধার্থে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্র নানান প্রাকৃতিক, জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে সময়ের হিসাব বা ধারণা প্রকাশ করা হয়। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র হিসাবমতো চলে।’ (সুরা-৫৫ আর রহমান, আয়াত: ৫)।

সময়কে ব্যবহারিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়। আরবি বর্ষপঞ্জি ও ইসলামি হিজরি সনের চতুর্থ মাস ‘রবিউস সানি’, একে ‘রবিউল আখির’ও বলা হয়। এটি ‘রবিউল আউয়াল’ মাসের জোড়া মাস। ‘রবি’ অর্থ বসন্ত, ‘আউয়াল’ অর্থ প্রথম, ‘সানি’ অর্থ দ্বিতীয়, ‘আখির’ অর্থ শেষ বা অন্য। ‘রবিউস সানি’ অর্থ হলো বসন্তকালের দ্বিতীয় মাস বা অন্য বসন্ত। মহানবী (সা.)-এর দুনিয়াতে আগমনের মাস, হিজরতের মাস ও তিরোধানের মাস রবিউল আউয়ালের জোড়া মাস হিসেবে রবিউস সানি মাসও বেশ তাৎপর্যময়।

রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ আখেরি নবী ও সর্বশেষ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাত দিবসকে ‘ফাতেহায়ে দোয়াজ-দাহম’ বলা হয়। রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ ওলিকুল শিরোমণি পীরানেপীর বড় পীরখ্যাত আওলাদে রাসুল শেখ সৈয়দ মুহিয়ুদ্দিন আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)–এর ওফাত দিবসকে ‘ফাতিহায়ে ইয়াজ-দাহম’ বলা হয়। সময় চলমান; বয়স বৃদ্ধি হয়, আয়ু ক্ষয় হয়। সময়কে কাজে লাগানো বা সময়ের সদ্ব্যবহারই জীবনের সফলতা এবং সময়ের অপচয় বা অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সময়ের শপথ! সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; শুধু তারা ক্ষতিগ্রস্ত নয় যারা বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে এবং সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যে উৎসাহিত করে।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)।

সময় অমূল্য সম্পদ। একে কর্মের মাধ্যমে মূল্যবান ও মূল্যায়ন করতে হবে। সময় জীবনের মূলধন বা পুঁজি। আমলের পসরার মাধ্যমে একে লাভজনক করতে হবে। না হলে কালের আবর্তের মহা গর্তে নিপতিত ও নিমজ্জিত হতে হবে। তিলে তিলে হিসাব দিতে হবে প্রতি মুহূর্তের। দুনিয়ার স্বল্প সময়ের ক্ষুদ্র আমলও পরকালের অনন্ত সুখের কারণ হবে। কোরআন মাজিদের ভাষায়, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা-ও সে দেখতে পাবে; আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করলে তা-ও সে দেখতে পাবে।’ (সুরা-৯৯ জিলজাল, আয়াত: ৭-৮)। প্রতি মাসের শুরু ও শেষে বিশেষ দোয়া কালাম ও নামাজ রোজা এবং বিশেষ নেক আমলের মাধ্যমে পালন করতেন নবীজি (সা.)। আমল দ্বারা সময়কে ঋদ্ধ করা ও জীবনকে সমৃদ্ধ করা জ্ঞানীর কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করো, যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে, জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে।’ (শুআবুল ইমান, বায়হাকি: ১০২৪৮, সহিহ আলবানি: ৩৩৫৫)।

সাধারণ সময়ও বান্দার ইখলাস ও তাকওয়াপূর্ণ সুন্নাতভিত্তিক নেক আমল ও ত্যাগ–তিতিক্ষা এবং শুভ উদ্যোগ ও সফল সার্থক অবদানের কারণে পুণ্যময় হয়ে ওঠে। হজরত আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনটি আমল কখনো পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হলো ১. তাহাজ্জুদের নামাজ, ২. প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ ‘আইয়ামে বিদ’-এর রোজা পালন ও ৩. রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ। (জামিউস সগির ও সহিহ বুখারি: ১৯৭৫)। নবীজি (সা.) প্রায়ই প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন। কারণ, এ দুই দিন বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পৌঁছানো হয়। বিশেষত সোমবারে জন্মগ্রহণ ও ওহিপ্রাপ্তির শোকরিয়াস্বরূপ তিনি এ আমল করতেন। (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৫, সহিহ আলবানি: ২৩৫৭)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]