রাসুল (সা.)–এর মৃত্যুতে কন্যা ফাতেমার শোকগাথা

প্রাচীন আরব ছিল কাব্যচর্চার উৎকৃষ্ট ভূমি। আরবেরা তাদের সেরা কবিতাগুলো কাবাঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখত। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর পরিবারেও কাব্যের চর্চা ছিল। নবীজির ওফাতের পর তাঁর আদরের কন্যা ফাতেমা (রা.) লিখেছিলেন শোকগাথা। তা নিয়েই এই লেখা।

নবীজির প্রস্থান: শোকগাথা বা মর্সিয়া রচনা আরবদের অনেক প্রাচীন রীতি। তবে আমাদের দেশে বাংলায় যে মর্সিয়ার প্রচলন, তা কারবালার কাহিনিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবত মর্সিয়া বা শোকগাথা, ইংরেজিতে যাকে বলে এলিজি—তা যে কারোর মৃত্যুশোকে রচিত হতে পারে।

মুহাম্মদ (সা.)–এর আগমনের বরকতে এবং তাঁর মহান শিক্ষার বদৌলতে বদলে গেল পৃথিবী, বদলে গেল পৃথিবীর রসম-রেওয়াজ ও প্রশাসনিক কাঠামো। মানবতার উত্তরণ ঘটল গ্রীষ্মের খরতাপ, লু হাওয়া, প্রচণ্ড দাহ থেকে আর দুর্ভিক্ষঘেরা এক ভয়ংকর ঋতু থেকে এমন এক ঋতুতে যেখানে গলাগলি করছে ফুল আর বসন্ত, যেখানে উদ্যান ঘেঁষে বয়ে চলেছে ছলছল প্রবাহের উচ্ছল ঝরনাধারা। তাঁর আগমনে পাল্টে গেছে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি, তাদের হৃদয়গুলো আপন প্রতিপালকের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল।

মানুষ ব্যাপকভাবে ধাবিত হলো আল্লাহর অভিমুখে। মানুষ সন্ধান পেল অপরিচিত এক নতুন স্বাদের, অজানা এক নতুন রুচির, অজ্ঞাত এক নতুন ভালোবাসার। এমন নবীই শেষ পর্যন্ত প্রস্থান করলেন।

তাঁর মৃত্যুতে শোকাতুর হয়ে পড়ল সবাই। সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলি নাদভি লিখেছেন,‘রাসুলের (সা.) ইন্তেকালের সংবাদ সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর ওপর বিজলিবৎ পতিত হয়। এর কারণ ছিল আল্লাহর রাসুলের সঙ্গে তাঁদের প্রেম-ভালোবাসা ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক—যার তুলনা মেলে না। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় থাকতে এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, যেভাবে সন্তান তার পিতা-মাতার স্নেহাঞ্চলের নিচে অবস্থান করে, বরং তার চেয়েও বেশি। এদিক দিয়ে তাঁদের ওপর তাঁর প্রভাবের কথা যতই বলা যাক, তা প্রকৃত অবস্থা থেকে কমই বলা হবে।’

পবিত্র কোরআনে বলা হচ্ছে, ‘তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন পয়গম্বর এসেছেন, যা তোমাদের জন্য কষ্টকর, তা তার নিকট দুর্বহ মনে হয় আর তিনি তোমাদের অতীব মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল।’ [সুরা তাওবা: ১২৮]
নবীজি (সা.)–এর ইন্তেকাল অনেকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। এমনকি ওমর (রা.) পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি। মসজিদে নববিতে এসে ভাষণ দেন। সেখানে ঘোষণা করেন,‘মুনাফিকদের পরিপূর্ণভাবে যতক্ষণ না আল্লাহ তাআলা নির্মূল করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর রাসুলের ইন্তেকাল হবে না।’ পরে অবশ্য নির্বৃত্ত হন আবু বকর (রা.)–এর ভূমিকায়। একপর্যায়ে আবু বকর (রা.) জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেখানে উল্লেখ করেন, ‘লোক সকল, যদি কেউ মুহাম্মদ (সা.)–এর আনুগত্য করে থাকে, তবে সে জেনে রাখুক, নিশ্চিতই তার মৃত্যু হয়েছে। আর যিনি আল্লাহর ইবাদত করেন তিনি (নিশ্চিত থাকুন ও) জানুন, আল্লাহ তাআলা চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই।’

কন্যার শোকগাথা: শেষ পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মদ মেনে নেয় রাসুল (সা.)–এর মৃত্যু হয়েছে। এই মেনে নেওয়া জগৎবাসীর জন্য শোক থেকে পরিত্রাণের একটি মানদণ্ড হতে পারে। নবীর যখন মৃত্যু হয়েছে, তখন সবার মৃত্যু অবধারিত।

এমনটি ইঙ্গিত মেলে রাসুলের কথায়ও। তিনি বলেন, ‘লোক সকল, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কারও মৃত্যুতে আঘাত পায়, তখন আমার মৃত্যুতে আঘাতপ্রাপ্ত লোকদের থেকে সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করবে। কেননা আমার মৃত্যুতে প্রাপ্ত শোকাবহ আঘাতের চেয়ে আমার উম্মতের ওপর কোনো বড় আঘাত আসবে না।’

সাহাবিরা যখন নবীজির দাফন শেষে ফিরে আসেন, তখন সাহাবি আনাসকে উদ্দেশ করে রাসুলকন্যা ফাতেমা আজজাহরা (রা.) বলে ওঠেন:
‘আনাস! রাসুলের দেহখানি
মাটি দিয়ে পারলে ঢেকে দিতে?
তোমাদের মন কীভাবে মেনে নিল এত সহজে?’

নবীজি (সা.)–এর সর্বাধিক স্নেহের ও আদরের দুলালি ছিলেন ফাতেমা। রাসুল (সা.) বলেন,‘ফাতেমা আমার শরীরের একটি অংশ। যে তাকে রাগান্বিত করবে, সে যেন আমাকে রাগান্বিত করল।’

আমরা আরও উদাহরণ পাই ফাতেমা ও রাসুলের সম্পর্ক নিয়ে। রাসুল (সা.) তাঁকে এত ভালোবাসতেন যে কোনো যুদ্ধ ও সফর থেকে ফিরলে প্রথমেই মসজিদে ঢুকে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। এরপরই ফাতেমার ঘরে গিয়ে তাঁর খোঁজখবর নিতেন। তারপর যেতেন স্বগৃহে—পত্নীদের কাছে।

খাতুনে জান্নাত ফাতেমাও রাসুল (সা.)–কে অত্যধিক ভালোবাসতেন। রাসুলের ইন্তেকালের পর তিনি মাত্র ছয় মাস জীবিত ছিলেন। পিতৃবিয়োগে তিনি এতই কাতর ছিলেন যে এই কয় মাসের মধ্যে তাঁকে কখনো হাসতে দেখা যায়নি।
রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর রক্তের ধারা একমাত্র ফাতেমার মাধ্যমেই অবশিষ্ট থাকে। কথাবার্তা, ওঠাবসা, খাওয়াদাওয়া ও চালচলন ছিল পিতা মুহাম্মদ (সা.)–এর মতো। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, ‘এমনকি ফাতেমার হাঁটাচলাও ছিল রাসুলের হাঁটাচলার মতো।’

রাসুল (সা.) তাঁকে জান্নাতের মহিলাদের নেত্রী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ফাতেমা বিভিন্ন সময় কবিতা আবৃত্তি করেছেন। রাসুল (সা.)–এর মৃত্যুতে তাঁর কয়েকটি শোকগাথার অনুবাদ এ লেখায় উল্লেখ করতে চাই। ফাতিমা (রা.) বলেন,
‘আকাশের প্রান্ত ধুলোয় মলিন
নবীর মৃত্যুতে আফসোস ও আক্ষেপে
পৃথিবী বিষণ্ন, বিমর্ষ ও
ভীত কম্পমান।
তাই মাগরিব–মাশরিকের সব লোক কাঁদো
কাঁদো মুদার গোত্র, কাঁদো ইয়েমেনবাসী।
কাঁদো হে বৃহৎ পর্বতরাজি, বৃষ্টি–বাদল,
কাঁদো দরদালান।
হে রাসুল আমার, বরকতময় নুরের কান্ডারি
কোরআনের মালিক তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন।
এমন বিপদ আর যাতনা আমাকে ছুঁয়েছে
যদি তা পতিত হতো দিনের ওপর
দিনগুলো সব হয়ে যেত রাত।
তোমার অনুপস্থিতি অনেক জটিল পরিস্থিতি ডেকে এনেছে
যদি তুমি থাকতে সেখানে বাগাড়ম্বর হতো না নিশ্চিত।
আমরা তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি পিতা
যেমন মাটি হারিয়ে ফেলে বৃষ্টিকে।
তোমার কওম বড় দুর্বল ও বিনষ্ট হয়ে গেছে।
আর দেরি করো না পিতা, জলদি নেমে এসো
দেখা দাও, অদৃশ্য থেকো না!’
পিতার কবরের কাছে গিয়ে ফাতেমা একদিন উচ্চারণ করেন:
‘সত্যই আমরা তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।
বঞ্চিত হয়েছি বরকত থেকে, যেমন—
মাটি বৃষ্টিপাতকে হারায়।
আমাদের থেকে বিদায় ওহি ও কিতাবের
হায়, তোমার আগেই যদি মৃত্যু নিয়ে যেত আমাকে,
তবে কখনোই আমি বিলাপ করতাম না।
তোমার সমুখে প্রতিবন্ধক হতো কিতাব।

সূত্র:
১. ইব্‌ন হিশাম, সীরাতুন নবী (সা.)
২. সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, নবীয়ে রহমত
৩. ড. আবদুল জলিল, কবি ও কবিতা সম্পর্কে রাসুল ও সাহাবীদের মনোভাব
৪. কবিতার অনুবাদ বর্তমান লেখকের নিজস্ব

*মহিউদ্দীন মোহাম্মদ: কবি ও আরবি সাহিত্যের গবেষক।