শিশুর সুরক্ষায় ইসলামের শিক্ষা ও আমাদের করণীয়

শিশুরা জান্নাতের ফুল। শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আমাদের স্বপ্ন তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে। পারিবারিক শান্তি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তাই শিশুদের মেধা বিকাশে ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবিধান খুবই জরুরি।

ইসলামি বিধানে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রথম বাবার ওপরেই বর্তায়। তাই বাবা হওয়ার আগে দাম্পত্যজীবন গঠনের প্রাক্কালেই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তোমরা তোমাদের সন্তানের জন্য ভালো ‘মা’ খুঁজে নেবে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সন্তানের মা যেন হয় সুশিক্ষিত, সম্ভ্রম ও মর্যাদাসম্পন্ন, সৎ চরিত্রবান এবং শোভন আচরণের অধিকারী, যাতে সন্তানের শৈশব নিরাপদ ও আনন্দময় হয়। নিরাপদ দাম্পত্যজীবন ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বিবাহের কাবিন রেজিস্ট্রি করতে হবে। না হলে সামাজিক ও পারিবারিক কলহসহ আইনত ঝামেলা পোহাতে হবে।

দাম্পত্যজীবন শুরুর আগে অনাগত সন্তানের সুরক্ষার জন্য এভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে শিখিয়েছেন মানবতার নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), ‘হে আল্লাহ আমাদের শয়তানের অনিষ্ট হতে রক্ষা করুন এবং আমাদের যে সন্তান আপনি দেবেন, তাকেও শয়তানের অনিষ্ট হতে রক্ষা করুন।’ (বুখারি: ৬৩৮৮, মুসলিম: ১৪৩৪)। সন্তান যখন মায়ের গর্ভে আসবে, তখন সন্তানের সুরক্ষার জন্য গর্ভধারিণী মায়ের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে, মাতৃত্বকালীন পরিচর্যা করতে হবে। প্রসবকালীন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

সন্তান জন্মের পর তার প্রথম অধিকার মায়ের বুকের শালদুধ তাকে দিতে হবে এবং দুই বছর মাতৃদুগ্ধ পান করাতে হবে, যা সন্তানের পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ও বেড়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য। মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলেও সন্তানকে তার এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আল–কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে, যদি তারা দুগ্ধপোষ্যের পূর্ণতা চায়। সন্তানের পিতা তার (মায়ের) ভরণপোষণ যথাযথভাবে বহন করবে। কাউকে তার সামর্থ্যের অধিক দায় চাপানো যাবে না। পিতা ও মাতা কেউ সন্তান দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না (তার ও সন্তানের ক্ষতি করবে না), তাদের উত্তরাধিকারীদের প্রতিও অনুরূপ বিধান।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৩৩)।

সন্তানের সুন্দর অর্থবহ নাম রাখতে হবে এবং জন্মনিবন্ধন করাতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আইনগত জটিলতায় পড়তে না হয়। তার নিরাপত্তা ও উজ্জ্বল সফল–সার্থক ভবিষ্যৎ কামনায় সামর্থ্য অনুযায়ী আকিকা করতে হবে। প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধক টিকা দিতে হবে। শিশুর সুষম খাদ্য ও সুন্দর পরিবেশ এবং সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর প্রথম শিক্ষালয় তার পরিবার, এরপর মক্তব, পাঠশালা বা বিদ্যালয়। শিশুর সুশিক্ষার জন্য পিতা-মাতা, অভিভাবক ও শিক্ষকের ভূমিকা প্রধান।

শিশুরা মাসুম, নিষ্পাপ। শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া বিধেয় নয়। এমনভাবে প্রহার করা যাবে না, যাতে কেটে যায়, ফেটে যায়, ফুলে যায়, দাগ হয় বা বিবর্ণ হয়। রাগের বশীভূত হয়ে শাস্তি প্রদান করা যাবে না। শরীরের এমন কোনো জায়গায় আঘাত করা যাবে না, যাতে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হতে পারে।

আমাদের সমাজে শিশুরা বঞ্চনা ও নিগ্রহের শিকার হয় গৃহে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে। কোথাও তাদের নিরাপত্তা নেই। বিদ্যালয়ে অদক্ষ, অযোগ্য, মানহীন শিক্ষক কর্তৃক অবোধ শিশুদের অমানবিকভাবে প্রহারের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা পরিচালক, কর্তৃপক্ষ বা কমিটি এবং দায়িত্বশীলদের আরও সচেতন ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

শিশুদের অবস্থানের সব স্থানে, (প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে) প্রাথমিক বিদ্যালয়, নুরানি মক্তব, হাফেজি মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত) সব শ্রেণিকক্ষে ও যৌথ শয়নকক্ষে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। এ জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, অভিভাবকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং দাতাদের এগিয়ে আসতে হবে।

আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবাসিক শিক্ষকদের সপরিবার থাকার বা রাখার বন্দোবস্ত করতে হবে। এতে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় তেমন বাড়বে না, বরং আবাসন সুবিধা ও সপরিবার রেশন-অন্ন সুবিধার বদৌলতে স্বল্প বেতনে, সহজ শর্তে বেশি দায়িত্ব পালনে তাঁরা আগ্রহী হবেন।

শিশুর মনোদৈহিক উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতা লাভের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সুশিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, আনন্দ–বিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। এতে মূল্যবোধ, সুকুমারবৃত্তি ও মানবিক গুণাবলির স্ফুরণ ঘটে। সভ্যতার উন্নয়নে বিশ্বনাগরিক সৃষ্টিতে শিশুদের প্রতি দায়িত্বশীল ও যত্নবান হতে হবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব

[email protected]