কলমের অলৌকিক উল্টো যাত্রা

সিরিয়ার আলেপ্পোতে হজরত জাকারিয়া (আ.)–এর সমাধি

মরিয়ম (আ.)-এর বাবার নাম ইমরান, মায়ের নাম হান্নাহ। তিনি ছিলেন তাঁদের একমাত্র সন্তান। বৃদ্ধ বয়সে হান্নাহের গর্ভে মরিয়মের জন্ম হয়। হান্নাহ সন্তান লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। একদিন তিনি দেখলেন, একটি পাখি তার বাচ্চাকে খাবার খাওয়াচ্ছে।

এ দৃশ্য তাঁর মাতৃত্বের তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে আরও উসকে দেয়। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন। হান্নাহ গর্ভবতী হন এবং মানত করেন, সন্তান জন্মালে তাঁকে মসজিদুল আকসার সেবক হিসেবে উৎসর্গ করবেন।

হান্নাহের মেয়েসন্তান জন্ম নেয়। নাম রাখা হয় মরিয়ম, যার সুরিয়ানি ভাষায় অর্থ ‘খাদেম’ বা ‘সেবক’। মানত অনুযায়ী, মসজিদুল আকসায় সেবক হিসেবে উৎসর্গের জন্য এ নাম ছিল যথার্থ। (ফাতহুল বারি, আল্লামা আসকালানী, ৬/৩৬৫)

মরিয়ম (আ.) বড় হন এবং বুদ্ধি-বিবেচনার বয়সে পৌঁছান। তখন প্রশ্ন ওঠে, পবিত্র উপাসনাগৃহের এই আমানত কার হাতে অর্পণ করা হবে? তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী, কাহিনরা (উপাসনাগৃহের ধর্মীয় সেবায় নিয়োজিত পবিত্র আত্মারা) মরিয়মের তত্ত্বাবধানের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, ১০/১৩)

আরও পড়ুন
মরিয়ম (আ.) বড় হন এবং বুদ্ধি-বিবেচনার বয়সে পৌঁছান। তখন প্রশ্ন ওঠে, পবিত্র উপাসনাগৃহের এই আমানত কার হাতে অর্পণ করা হবে?

হজরত জাকারিয়া (আ.) ছিলেন মরিয়মের খালা ইয়াশির স্বামী এবং একজন নবী, তাই তাঁর চেয়ে উপযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু তত্ত্বাবধান নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। মীমাংসার জন্য লটারির আয়োজন করা হয়।

সেকালে লটারি হতো কলমের মাধ্যমে। প্রত্যেকে তাওরাত লেখার কলম পানিতে নিক্ষেপ করেন। যাঁর কলম স্রোতের বিপরীতে চলবে, তিনি বিজয়ী হবেন। সবার কলম স্রোতে ভেসে যায়, কিন্তু জাকারিয়া (আ.)-এর কলম স্রোত উপেক্ষা করে উল্টো দিকে চলে।

কলম স্রোত উপেক্ষা করে উল্টো দিকে চলে
প্রতীকি ছবি: এআই

ইসরায়েলি বর্ণনা অনুসারে, তিনবার লটারি হয় এবং প্রতিবারই জাকারিয়া (আ.)-এর নাম উঠে আসে। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, তাঁর সঙ্গে গায়েবি সাহায্য রয়েছে। ফলে মরিয়মের তত্ত্বাবধান তাঁর হাতে অর্পণ করা হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ২/৪৮৮; কাসাসুল কোরআন, ১০/১৩)

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এ হলো অদৃশ্যের সংবাদ—যা আমি তোমাকে পাঠিয়ে থাকি। আর তুমি তো তাদের কাছে ছিলে না, যখন তারা প্রতিযোগিতা (লটারি) করছিল—কে প্রতিপালন করবে মরিয়মকে এবং তুমি তাদের কাছে ছিলে না, যখন তারা ঝগড়া করছিল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৪৪)

‘নিশ্চয় আমি তার নাম রেখেছি মারইয়াম। আর নিশ্চয় আমি তাকে ও তার সন্তানদের বিতাড়িত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয় দিচ্ছি। তারপর তার প্রতিপালক তাকে ভালোভাবে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালনপালন করলেন এবং তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৬-৩৭)

আরও পড়ুন
তার প্রতিপালক তাকে ভালোভাবে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালনপালন করলেন এবং তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন।
সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৬-৩৭

মরিয়ম (আ.) এতিম ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পুরুষ অভিভাবক ছিল না। কেউ কেউ বলেন, সে সময় দুর্ভিক্ষ ও আর্থিক সংকটের কারণে তাঁর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কারও না কারও নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। মায়ের মানত অনুযায়ী, তিনি উপাসনাগৃহের জন্য উৎসর্গিত ছিলেন, তাই সৎ ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে থাকা ছিল অপরিহার্য। (তাফসিরে তরজুমানুল কোরআন, ১/৪৪৩)

জাকারিয়া (আ.) মরিয়মের জন্য মসজিদুল আকসার পাশে একটি কক্ষ নির্দিষ্ট করেন। তিনি দিনে সেখানে থাকতেন এবং রাতে খালার বাসায় বা জাকারিয়ার স্ত্রীর কাছে চলে যেতেন। উপাসনাগৃহে তিনি আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটাতেন। তাঁর জন্য জান্নাত থেকে খাবার আসত, যা দেখে জাকারিয়া (আ.) বিস্মিত হতেন।

হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, শরিয়তের নির্দিষ্ট হকের মীমাংসা লটারির মাধ্যমে করা অবৈধ এবং তা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। যেমন শরিকানাধীন সম্পত্তি বা শিশুর পিতৃত্ব নির্ধারণে লটারি নিষিদ্ধ। তবে জনগণের রায়ের ওপর নির্ভরশীল হকের মীমাংসায় লটারি বৈধ। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মদ শফি, পৃ. ১৭৫)

মরিয়ম (আ.)-এর জন্ম ও তত্ত্বাবধানের ঘটনা আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা ও তাঁর প্রতি তাঁর বান্দাদের ভরসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 লেখক: আলেম

আরও পড়ুন