এপিফানি লাল গির্জা এবং তিনজন খ্রিষ্টান শহীদ

বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন এপিফানি গির্জা
ছবি: অশোক অধিকারী

বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন এপিফানি গির্জাটি দিনে দিনে বিশ্বের বহু খ্রিষ্টভক্তের পবিত্র তীর্থভূমি হয়ে উঠেছে। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিখ্যাত এই বার্সিলিকাটি যতই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে, ততই যেন এপিফানিদের আধ্যাত্মিকতা ও সেবা-ব্রতের হিউম্যানিটি এ দেশের মাটিতে সার্থকরূপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো অনেকেই জানি না, সুদীর্ঘ ১২০ বছরের ঐতিহাসিক এই স্থানটি রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় এখানে খুন হয়েছেন তিনজন বিদেশি ফাদার। মানবসেবা ও খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য জীবন উৎসর্গীকৃত সেই তিনজন খ্রিষ্ট শহীদের মৃত্যুর চাপাপড়া করুণ ইতিহাসও কিন্তু এপিফানি লাল গির্জার প্রতিটি লাল ইটের মতোই টকটকে লাল।

গির্জাটি এখন ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের চিত্তাকর্ষণের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো অনেকেই জানি না, অক্সফোর্ড মিশনের লাল গির্জার পুরো সুনামের পেছনে রয়েছে তিনজন আত্মবলিদানকারী বিদেশির মর্মান্তিক মৃত্যুর ট্র্যাজিক অধ্যায়। যদিও আজ পর্যন্ত জানা যায়, এখানকার তিন বিদেশি মিশনারি খুনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল একটাই। আর তা হলো, লাল গির্জার সিন্দুকে রয়েছে মহামূল্যবান সোনার তৈরি কয়েকটি পানপাত্র। গির্জায় প্রভুর ভোজের জন্য এসব পানপাত্র পবিত্র রুটি ও দ্রাক্ষারস ভক্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ব্যবহার করা হতো। জনশ্রুতি আছে, এর একটি পানপাত্রের ঢাকনার ওপরে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে মূল্যবান একটি মুক্তাও খচিত আছে। এ দেশের কিছু বাঙালি ডাকাত বারবার লাল গির্জার এই মহামূল্যবান সম্পদ চুরি করতে এসে সিন্দুকের চাবি না পেয়ে ফাদারদের খুন করেছে।

গির্জার সম্পদ বাঁচাতে ১৯৩৫ সালের ৭ মে রাতে ঘাতকদের হাতে প্রথম খুন হন ফাদার ফ্রেডেরিক হিউলেট। তিনি গির্জার পাদদেশে বেল টাওয়ারে রাতে একাই ঘুমাতেন।

তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় আততায়ীরা খুন করে। এরপর খুন হন ফাদার অ্যালেন রোনাল্ড ম্যাকবেথ। তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৫ সালে বরিশালে আসেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের রাতে কয়েকজন ডাকাত গির্জার সিন্দুকের চাবি না পেয়ে তাঁকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর উৎসাহিত ঘাতকদের হত্যার সর্বশেষ শিকার হন মহান ফাদার এল ডব্লিউ সি রিগবি। তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় ছিলেন। পৌরোহিত্যগুণে অনুপ্রাণিত হয়ে ইংল্যান্ডের মিরফিল্ড ইংলিশ চার্চে যাজকীয় পদে অভিষিক্ত হন।

গির্জাটি এখন ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের চিত্তাকর্ষণের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো অনেকেই জানি না, অক্সফোর্ড মিশনের লাল গির্জার পুরো সুনামের পেছনে রয়েছে তিনজন আত্মবলিদানকারী বিদেশির মর্মান্তিক মৃত্যুর ট্র্যাজিক অধ্যায়

এরপর কলকাতা এসে কাজ শুরু করেন। যুবক রিগবি ১৯৪৬ সালে প্রথম রিট্রিটে যোগ দিতে বরিশালে আসেন। ১৯৫৩ সালে অক্সফোর্ড মিশন স্কুলের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিয়ে বরিশালে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। ছোট-বড় প্রায় প্রত্যেকের প্রিয়-প্রাণচাঞ্চল্যে উচ্ছ্বসিত, সবার আপনজন, সংসারত্যাগী পুণ্যাত্মা সন্ন্যাসী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আততায়ীরা এই ফাদারকে খুন করে। ২২ সেপ্টেম্বর তাঁর লাশ সিঅ্যান্ডবি কোয়ার্টারের পুকুরে ভাসতে দেখা যায়। ফাদারের পকেটে বেল-ঘরের চাবি পাওয়া যায়নি। এভাবেই ঐতিহ্যবাহী লাল গির্জার পুরোহিতেরা নিহত হয়েছেন।

বর্তমানে জীবনানন্দ দাশ সড়কে অবস্থিত, পামগাছে ঘেরা ফাঁক দিয়ে তাকালেই যে টেরাকোটা লাল রঙের সুউচ্চ আর্চওয়ে গির্জাটি দেখা যায়, শতবর্ষের অধিক বয়সী এই গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল মিশন আরম্ভের চার বছর পরে। স্কুল, বোর্ডিং, ছাত্রাবাস, ছাত্রী হোস্টেল, ফাদার-সিস্টারদের থাকার ঘর, শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং মেডিকেল সেন্টার তৈরির কাজ মোটামুটি শেষ করে পুরোহিতেরা এখানে একটি সুন্দর প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের কথা ভাবলেন। তাঁরা তখন এ–ও ভাবলেন, ঈশ্বরের উপাসনা-মন্দির অবশ্যই নয়নাভিরাম ও গভীর আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ হতে হবে।

এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে ফাদার স্ট্রং র‌্যাভেন্নার সুন্দর গির্জার গথিক স্থাপত্যশিল্পের অনুকরণে এদেশীয় প্রাচীন মহামন্দিরের আদলে গির্জাটি করার পরিকল্পনা করেন।

ফাদার স্ট্রংয়ের ইচ্ছানুযায়ী, তখন সিস্টার ইডিথ গির্জাটির প্রাথমিক স্কেজ তৈরি করেন এবং ইংল্যান্ডে বসবাসরত ফাদারের এক বন্ধু স্থপতি ফিলিপ থিকনেস গির্জাটির ভেতর-বাইরের নকশার আর্কিটেকচার তৈরি করেন। এরপর ক্ষেত্রমণি দত্তের উইল থেকে পাওয়া ২৫ হাজার টাকা দিয়ে গির্জার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। ক্ষেত্রমণি ছিলেন তখনকার সুকবি তরুণ দত্তের মা। অল্প বয়সেই বাবা, ভাই ও কবির মৃত্যু হলে ক্ষেত্রমণি দত্ত তাঁদের সব অর্থসম্পদ মিশনকে উইল করে দেন। গির্জাটি নির্মাণের বাকি টাকার জোগান দিয়েছিলেন ক্যানিংটনের সেন্টজন গির্জার সহকারী যাজকের বোন অক্টোভিয়া ব্রুক। ১৯০৪ সালের মার্চ মাসে এর ভিত্তিপ্রস্তর হয়। ১৯০৬ সালে বড়দিনের রাতের এপিফানি উপাসনার মাধ্যমে প্রথম অসমাপ্ত চার্চটির ব্যবহার শুরু হলেও ১৯০৭ সালে আকর্ষণীয় এই গির্জার কাজ পুরোপুরি শেষ হয়।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, এমন স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের গির্জা বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। স্থাপত্যবিদদের ধারণা, ধর্মীয় পরিবেশের পবিত্রতা ছাড়াও স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তিগুলোর অন্যতম।


হেনরি স্বপন, কবি ও লেখক