ক্রিসমাস: ইতিহাস, স্মৃতি, জীবন

জুলিয়ান ফ্রান্সিস
জুলিয়ান ফ্রান্সিস

আমার বড়দিনের প্রথম স্মৃতি ১৯৪০-এর দশকের শেষের বা ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকের, যুক্তরাজ্যে। সেখানে তখনো যুদ্ধোত্তর (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) খাদ্য রেশনিং চলছে। আমার মা রেশনের ভাউচার খাবারে খরচ না করে বড়দিন ও জন্মদিনের চকলেট ও মিষ্টির জন্য জমিয়ে রাখতেন। তাই ছোটরা, মানে আমি ও আমার ভাই-বোনেরা বড়দিনের খুব ভক্ত ছিলাম। বড়দিন যেমন হয় তেমন করেই আসতো আমাদের কাছে। আমরা সবাই মা’কে পুডিং বানাতে সাহায্য করতাম। আর সেই চমৎকার মিশ্রণ ঘাঁটতে ঘাঁটতে মনে মনে নানা রকম বর চাইতাম। বড়দিনের এক সপ্তাহ আগে স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে ক্রিসমাস বৃক্ষ বানিয়ে তা সাজাতাম। আর বড়দিনের দিন সেই বৃক্ষের তলে জড়ো হওয়া সব উপহারগুলো আমরা খুলতে বসতাম। 
১৯৪০-এর শেষের দিকে নানি আমাদের সঙ্গে থাকতেন। বাইবেল পড়ে যিশুর জন্মের ব্যাপারটা আমরা ঠিকঠাক বুঝলাম কি না, তিনি তা নিশ্চিত করতেন। তিনি বলতেন, এই একে অপরকে উপহার দেওয়ার ব্যাপারটা আসলে যিশুকে তিন রাজার উপহার দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। যিশুর জন্মের বারোতম রাতে, ৬ জানুয়ারি তাঁদের তাঁর কাছে পৌঁছানোর কথা।
আমার নানার এক ভাই ইথিওপিয়ায় ধর্ম প্রচারক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি সেখানে সন্ত ম্যাথিউয়ের গির্জা বানিয়েছিলেন। সাধারণত তিনি পাঁচ বছর পর পর যুক্তরাজ্যে বেড়াতে আসতেন। একবার তিনি আমাকে সেই গির্জার ভিত খোঁড়ার সময় রোমান মুদ্রা পাওয়ার গল্প বলার সময় বলেছিলেন, যিশুখ্রিষ্টের জন্ম আসলে কখন হয়েছে সেটা কেউ নিশ্চিত নয়। বাইবেলের ভাষ্যমতে, মেষপালকেরা রাতের বেলা মেষ দেখাশোনা করছিল। আমার আরেক দাদা বলেছিলেন, সেটা সম্ভবত শরৎ অথবা বসন্ত, মধ্য শীত নয়। তিনি বুঝিয়েছিলেন, যিশুর মৃত্যুর পর তাঁর আত্মদান স্মরনে ইস্টার দিবস পালন করা হতো, জন্মদিন নয়। চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের আগে রোমান শাসকেরাও ২৫ জানুয়ারি যিশুর জন্মদিন নির্ধারণ করেননি। তিনি আমাকে বলেন, অবিশ্বাসীরা সূর্য উপাসনা করত। তাঁরা বছরের দীর্ঘ ও ক্ষুদ্রতম দিন উদ্যাপন করত। রোমান ক্যালেন্ডার অনুসারে, সে সময় শীতের ক্ষুদ্রতম দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। রোমান নেতারা ভাবলেন, যিশুর জন্মদিন যদি ২৫ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়, তাহলে আরও অনেক অবিশ্বাসী খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করবে। অবিশ্বাসীরা তখন রোমান কৃষি দেবতা (স্যাটার্ন) ও পারস্য আলোর দেবতার (মিথরা) পূজা করত একই দিনে, আর তা হতো ২৫ ডিসেম্বর।
তবে এই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটি নির্ধারণ করার পেছনে আরও একটি কারণ আছে, সেটা সম্ভবত ধর্মতাত্ত্বিক। ইতিহাসবিদেরা বলেন, দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছে বসন্তের এক দিনে, যখন দিন-রাত্রি সমান। তার চার দিন পর ২৫ মার্চ আলোর সৃষ্টি হয়। যিশুর জন্ম এক নতুন কালের ইঙ্গিত দেয় বা নতুন সৃষ্টির জানান দেয়। বাইবেলের ভাষ্যকারেরা ধরে নেন, যিশুকে তাঁর মা গর্ভধারণ করেন ২৫ মার্চ। ফলে তাঁরা তাঁর জন্মের তারিখ নির্ধারণ করেন ২৫ ডিসেম্বর, নয় মাস পর।
এই মাত্র ৫০০-৬০০ বছর আগে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশুর জন্মদিন উদ্যাপন শুরু হয়। এমনকি ১৮০০ সাল পর্যন্ত ইউরোপে বড়দিন তেমন জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হতো না। কারণ, এই পার্টি করা বা আনন্দ করা অনেকটা অখ্রিষ্টান কাজ বলে ধরা হতো। ১৮৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিনকে ছুটি ঘোষণা করা হয়। তার বেশ আগে ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক অলিভার ক্রমওয়েল বড়দিন ‘বাতিল’ ঘোষণা করেন। আর মার্কিন কলোনির পিউরিটানরা বোস্টনে বড়দিন উদ্যাপন নিষিদ্ধ করেন। আর যাঁরা তা উদ্যাপন করেছে, তাদের পাঁচ শিলিং জরিমানাও করা হয়েছে সেখানে।
আমার নানার জ্ঞানী চাচাত ভাই ক্রিসমাস বৃক্ষের জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কেও বলেছেন। তাঁর মতে, প্রাচীন মিসরীয়রা মনে করত চিরসবুজ গাছ আসলে চিরজীবনের লক্ষণ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে রানি ভিক্টোরিয়ার জার্মান স্বামী ১৮৪৬ সালে উইন্ডসর প্রাসাদে ক্রিসমাস বৃক্ষ নিয়ে আসেন।
আর আমাদের পিতা ক্রিসমাস বা সান্তা ক্লজ তো আছেনই। তিনি কচিকাঁচাদের জীবনে প্রভূত আনন্দ বয়ে আনেন। সারা দুনিয়ায় একই রাতে শিশুদের উপহার দেন। যখন শিশু ছিলাম, তখন ২৪ ডিসেম্বর রাতে ফায়ারপ্লেসের পাশে বড় একটি মোজা ঝুলিয়ে দিতাম। আমার বোন ও আমি একটি থালায় সান্তার জন্য কিছু কেক ও বিস্কুট রেখে দিতাম। আর এক গ্লাস শেরি এবং পোর্টও রাখতাম। তাঁর শরীর নিশ্চিতভাবেই এ দুটো কারণে গরম হত। আমি সান্তার বল্গা হরিণের জন্য কিছু গাজরও রাখতাম। বড়দিনের সকালে আমি ও আমার বোন এসে দেখতাম, বড় মোজাটি উপহারে ভরে গেছে। আর শুনতাম, সান্তা ও তাঁর বল্গা হরিণ আশপাশেই আছে। শরীর গরম করা পানীয়ের গ্লাসও থাকত খালি। থালায় থাকত শুধু শুকনো খাবারের ছোট ছোট টুকরা। গাজরও থাকত না বললেই চলে, শুধু কয়েকটা অর্ধেক খাওয়া টুকরা ছাড়া।
হ্যাঁ, বড়দিন সম্পর্কে এসবই মনে পড়ে। আর চার্লস ডিকেন্স বড়দিন সম্পর্কে কী বলেছেন, তা-ও মনে করিয়ে দেওয়া সমীচীন: ‘দয়ালু, ক্ষমাশীল, পরহিতকর সময়। বছরের এ সময়টাতেই একই ভাবনায় নর-নারীর হৃদয়ের বদ্ধ দ্বার খুলে যায়। এ সময় তাঁরা নিচের শ্রেণির মানুষদের আলাদা কোনো প্রজাতি হিসেবে দেখে না। সেই মানুষেরাও তাদের মতো একই পথের যাত্রী, সবাই কবরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে—এরূপ ভাবনা দীর্ঘ বছরের শুধু একটি দিনেই উদয় হয়।’ আজও এটাই বড়দিনের সারবস্তু হওয়া উচিত। লোভী বাণিজ্য নয়, মানুষের হৃদয়ে এ বাণীই ধ্বনিত হোক।
শেষ করব ১৯৭১ সালে ভারতের শরণার্থী শিবিরের বড়দিন দিয়ে। হিন্দু-মুসলমানরা ঠিক করেছিল, বাংলাদেশি শরণার্থীদের মধ্যে কিছু খ্রিস্টান পাওয়া গেলে তাদের নিয়ে বড়দিন পালন করা হবে। সর্বোপরি, তারা তখন কেবলই তাদের বিজয় উদ্যাপন করেছে, সবাই দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব। অনেকেই বলাবলি করছিল, নতুন এক জীবন শুরু হতে যাচ্ছে তাদের। আজ ২০১৪ সালে, সেই একই চেতনা কি বাংলাদেশে অনুভূত হবে? আশা করব যেন হয়...

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
লেখক: ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য পরিচালিত অক্সফামের ত্রাণ তৎপরতার সমন্বয়ক ছিলেন। এখন বাংলাদেশে বসবাস করছেন।