জীবনের নির্যাসে রচিত সিরাতগ্রন্থ ‘আর রাহিকুল মাখতুম’

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত তথা জীবনী নিয়ে প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখালেখি চলছে। এ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে হাজার হাজার মূল্যবান গ্রন্থ। তাঁর জীবনী পাঠে মানুষের হৃদয়ের গভীরে অনুভূত হয় অন্য রকম এক প্রশান্তির ছোঁয়া। তাই নবীজি (সা.)–এর জীবনীর পাঠক কখনো ক্লান্ত হয় না। পাঠকের চাহিদা আছে বলে এত বিপুলসংখ্যক গ্রন্থ লেখা হয়েছে এবং এই ধারা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।


আধুনিক যুগের সিরাতগ্রন্থসমূহের মধ্যে মাওলানা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (মৃ. ২০০৬ খ্রি.) রচিত ‘আর রাহিকুল মাখতুম’ অন্যতম। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার ‘রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামি’ আয়োজিত বিশ্বব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা.) প্রতিযোগিতায় ১ হাজার ১৮২টি পাণ্ডুলিপি থেকে প্রথম পুরস্কার বিজয়ী এই সিরাতগ্রন্থে রাসুল (সা.)-এর জীবনী খুব সুন্দর ও পরিপাটি করে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ আরবি ভাষায় লেখা। ইতিমধ্যে সিরাতগ্রন্থটি বাংলাসহ বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। ইসলাম নিয়ে যাঁরা জানতে চান, তাঁদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে এই সিরাতগ্রন্থ।


‘আর রাহিকুল মাখতুম’–এর লেখক তাঁর প্রতিভার ছাপ রেখেছেন গ্রন্থটির পাতায় পাতায়। হাজারো সিরাতগ্রন্থের তথ্যভান্ডার থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য বাছাই করে নিখুঁত ধারাবাহিকতায় সাজিয়েছেন নবীজি (সা.)–এর জীবন ও আদর্শ। লেখক ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন যে রাসুল (সা.) মানুষকে আলোর পথে পরিচালিত করতে সারা জীবন সাধনা করেছেন, দেখা পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশাল বিষয়কে সুচারুরূপে উপস্থাপন করা এবং সাবলীল ভাষারীতির প্রয়োগ এ সিরাতগ্রন্থটিকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। এর প্রতিটি পাতায় যেন মুক্তো ছড়িয়ে রাখা হয়েছে।

লেখক এই সিরাতগ্রন্থের সূচনায় প্রাক্‌-ইসলামি যুগের আরবের ভৌগোলিক পরিচয়, বিভিন্ন জাতির অবস্থান, আরবের নেতৃত্ব ও শাসনব্যবস্থা, তাঁদের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থাসহ মানবতার ধ্বংসের করুণ এক চিত্র এঁকেছেন। আঁধারে ঘেরা পৃথিবী যেন আশা–জাগানিয়া সুবহে সাদিকের প্রহর গুনছে। আরবের ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ বংশে আবদুল্লাহর ঔরসে মা আমিনার কোলে আগমন করলেন ‘আল-আমিন’ তথা সত্যবাদী স্বীকৃত প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর পিতৃহীন শৈশব কাটে দুধমাতা হালিমার ঘরে। ছয় বছর বয়সে মাতাকে হারিয়ে দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে প্রতিপালিত হতে থাকেন। আট বছর বয়সে দাদা ইন্তেকাল করলে চাচা আবু তালিবের গৃহে বড় হতে থাকেন। মক্কার জাহেলি সমাজে যৌবন কাটিয়ে দেন। তাঁর চরিত্রে জাহেলিয়াতের কালিমা বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। ৪০ বছর বয়সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত রাসুল হিসেবে তাঁর কাছে আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়। আল্লাহর বাণী এই মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অনুসারেই তিনি মানবতাকে মুক্তির দিশা দিয়েছেন। তাঁর বিজ্ঞ সহধর্মিণী আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘তাঁর (রাসুল সা.–এর) চরিত্র ছিল আল-কোরআন।’ লক্ষাধিক সাহাবি তাঁর সুমহান আদর্শ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ রাসুল (সা.)-এর সিরাত ও সুন্নাত লিপিবদ্ধ এবং মুখস্থ করেছেন যে এর মধ্যে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকে না।


লেখক রাসুল (সা.)-এর সিরাতসমূহ থেকে তথ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো গ্রহণযোগ্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ। রাসুল (সা.) হচ্ছেন বিশ্ববাসীর জন্য উত্তম পথনির্দেশক। তাঁর জীবনে তিনি যা করেছেন, যা করতে বলেছেন, যা করার অনুমোদন দিয়েছেন, তা–ই ইসলাম। এ জন্য সিরাতগ্রন্থ রচনায় নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র জরুরি। অনেক লেখক তাঁদের সিরাতগ্রন্থে দুর্বল ও মিথ্যা বর্ণনার উল্লেখ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই দুর্বল ও বানোয়াট তথ্যে রচিত রাসুল (সা.)-এর সিরাতগ্রন্থ নিয়ে অবান্তর প্রশ্ন তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত বিচারে দেখা যায়, এসব প্রশ্নের ভিত্তি একধরনের বানোয়াট বর্ণনার ওপর, যার সঙ্গে নবীজি (সা.)–এর জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই।

‘আর রাহিকুল মাখতুম’ বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করলেও বিশেষজ্ঞরা গ্রন্থটির কিছু সমালোচনাও করেছেন। অনেকের মতে, গ্রন্থটিতে নবীজি (সা.)–এর জীবনের কোনো কোনো তথ্য বাদ পড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর আদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে আরেকটু ব্যাখ্যা থাকলে পাঠকের জন্য আরও সুখকর হতো। তবে এসব তেমন ঘোরতর অভিযোগ নয়। সংক্ষেপে মহানবীর জীবনকে তুলে ধরার জন্য লেখক অনেক তথ্য বাদ দিয়েছেন বা ছোট করে বলেছেন।


নবীজির জীবনের সার নির্যাস নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘আর রাহিকুল মাখতুম’। এতে রাসুল (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি ইসলামি সমাজ গঠনের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা রয়েছে। রাসুল (সা.) পরিবারের কাছে প্রিয়পাত্র ছিলেন, সামাজিক জীবনে ছিলেন পরোপকারী ও সবার বন্ধু, অর্থনীতিতে ছিলেন উন্নয়নের রূপকার, রাষ্ট্রীয় জীবনে ছিলেন একজন সুকৌশলী সংগঠক, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন শান্তির বার্তাবাহক। সভ্যতার পরশ থেকে বঞ্চিত একটি জাতিকে কীভাবে উন্নত চরিত্রবান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেই শিক্ষা নিতে রাসুল (সা.)-এর জীবনীপাঠের গুরুত্ব সীমাহীন। আদর্শ ব্যক্তি ও নেতা হিসেবে রাসুল (সা.)-কে জানতে হলে ‘আর রাহিকুল মাখতুম’ সিরাতগ্রন্থটি প্রত্যেকের পড়া চাই।


* মো. মুহিবুর রহমান: প্রভাষক, ইসলাম শিক্ষা বিভাগ, মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজ।