প্রিয় নবীজির প্রিয় প্রসঙ্গ

.
.

প্রিয় নবীজি (সা.)-এর জীবন পরিক্রমায় অনেকগুলো ধাপ বা পর্ব রয়েছে। প্রথম ধাপ হলো খলকে নবী (সা.), অর্থাৎ নবীজি (সা.) সৃষ্টিতত্ত্ব। এ হলো সৃষ্টিসূচনার আদি পর্ব। দ্বিতীয় ধাপ হলো তাঁর বেলাদাত বা মিলাদুন নবী (সা.) তথা দুনিয়াতে শুভাগমন পর্ব। এটি হলো বাবা হজরত খাজা আবদুল্লাহর ঔরস থেকে মা আমিনার গর্ভে গিয়ে দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়। তৃতীয় ধাপ হলো সিরাতুন নবী (সা.), এটি হলো জন্মের পর থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত। চতুর্থ ধাপ হলো বেআছত বা জহুরে নবুওয়াত, অর্থাৎ নবুওয়াতি জিন্দেগি। এটি হলো ৪০ বছরের পর থেকে ৬৩ বছর তথা ওফাত পর্যন্ত প্রায় ২৩ বছর। পঞ্চম ধাপ হলো বারযাখে হায়াতুন নবী (সা.) বা নবীজির বারযাখি জীবন। এটি হলো ওফাতের পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়। ষষ্ঠ ধাপ হলো হায়াতে উখরবি বা পরকালীন জিন্দেগি। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘অবশ্যই আপনার জন্য ইহকাল অপেক্ষা পরকাল উত্তম।’ (সুরা-৯৩ দুহা, আয়াত: ৪)।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের প্রায় সাত মাস আগে তাঁর পিতা হজরত খাজা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। জন্মের পর তিনি কয়েক দিন মায়ের দুধ পান করেন। অতঃপর তত্কালীন আরবের প্রথা অনুযায়ী কিছুদিন পরিচারিকা সুআইবিয়ার ও পরে দুবছর দাই মা হালিমা (রা.)-এর দুধ পান করেন। ৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচ বছর বয়সে মহানবী (সা.) মা আমিনার সঙ্গে প্রথম মদিনায় মাতুলালয়ে গমন করেন। তাঁর নানার নাম আবদুল ওয়াহহাব। তখন তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে লালিত হচ্ছিলেন। ৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দে নবীজির সাত বছর বয়সে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন। তখন তিনি পিতৃব্য আবু তালিবের দায়িত্বে পালিত হন। ৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে ১২ বছর বয়সে মহানবী (সা.) প্রথমবারের মতো চাচা আবু তালিবের সঙ্গে ব্যবসায়িক কাফেলায় সিরিয়ায় যান।
তরুণ বয়সে তিনি মানবসেবা ও জনকল্যাণে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংঘ গঠন করেন। ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ বছর বয়সে তিনি হজরত খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। খাদিজা (রা.)-এর আগ্রহে অভিভাবক চাচা আবু তালিবের নির্দেশে ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.)-এর ২৫ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে হজরত খাদিজা (রা.)-এর শুভ পরিণয় হয়। তখন হজরত খাদিজা (রা.)-এর বয়স ৪০ বছর, এর আগে তাঁর আরও দুটি বিয়ে হয়েছিল, সে স্বামীদ্বয় মৃত্যুবরণ করেন; ওই উভয় ঘরের সন্তানও তাঁর ছিল। ২৫ থেকে ৫২ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের ২৭ বছর একমাত্র বিবি খাদিজা (রা.)-কে নিয়ে নবীজি (সা.) দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। নবীজি (সা.)-এর আট সন্তানের মধ্যে এই ঘরেই তিন পুত্র কাসেম (রা.), তাহের-তৈয়ব (রা.), আবদুল্লা (রা.) এবং চার কন্যা জয়নব (রা.), রুকাইয়া (রা.), উম্মে কুলছুম (রা.) ও ফাতিমা (রা.)—মোট সাত সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। আর এক পুত্র (ইবরাহিম রা.) মদিনায় হজরত মারিয়া কিবতিয়া (রা.)-এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩৫ বছর বয়সে মহানবী (সা.) বায়তুল্লাহ বা কাবা শরিফ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন ও তা স্থাপন করেন। এ সময় তিনি সর্বত্র ‘আল আমিন’ বিশ্বাসী বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি জীবনে কখনো অসত্য বলেননি।
৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে ৩৭ বছর বয়স থেকে নবীজি (সা.) জাবালে নুরে (হেরা গুহায়) অবস্থান করে ধ্যান সাধনায় নিমগ্ন হতে শুরু করেন। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে মহানবী (সা.) ওহি লাভ করেন। নবুওয়াতের প্রথম সত্যায়নকারী হলেন হজরত খাদিজা (রা.)-এর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল। প্রথম ইসলাম কবুল করেন হজরত খাদিজা (রা.), এরপর হজরত আবু বকর (রা.), তারপর হজরত আলী (রা.)। প্রথম তিন বছর তিনি ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্তজনদের কাছে ইসলাম প্রচার করেন। এ সময় তিনি দারে আরকামে, অর্থাৎ সাহাবি হজরত আরকাম (রা.)-এর বাড়ির ভেতরে সাহাবিদের তালিম বা দীক্ষা দিতেন। ইতিমধ্যে চাচা হজরত আমির হামজা (রা.) ও হজরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সাহাবিসংখ্যা ৪০ পূর্ণ হয়। ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে নবুওয়াতের চতুর্থ বছরে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সহধর্মিণী হজরত খাদিজা (রা.) ও চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। এটি ‘আমুল হুজন’ বা দুঃখ বছর নামে গণ্য করা হয়। ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ গমন করেন। ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে মিরাজ বা ঊর্ধ্বগমন সংঘটিত হয়। এই মিরাজেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়। মক্কার শেষ তিন বছর বিভিন্ন গোত্রের কাছে দাওয়াত পৌঁছান। এ সময় প্রথম আকাবার শপথ ও দ্বিতীয় আকাবার শপথ সম্পন্ন হয় এবং হজরত মুছআব ইবনে উমায়ের (রা.)-কে মুআল্লিম হিসেবে মদিনায় পাঠানো হয় ও সাহাবিরা মদিনায় হিজরত করতে থাকেন।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত আবু বকর (রা.)-এর আগ্রহে তাঁর কন্যা হজরত আয়িশা (রা.)-এর সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ বছরই মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের সময় সঙ্গে ছিলেন হজরত আবু বকর (রা.) এবং আমান ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নবীজির গৃহে তাঁর বিছানায় অবস্থান করছিলেন হজরত আলী (রা.)। হিজরত কালে তিনি জাবালে সুর বা সুর পাহাড়ে তথা সুর গুহায় তিন দিন আত্মগোপনে ছিলেন। কাফিরেরা সন্ধানে এলে এখানেই গুহার মুখে মাকড়সা জাল বুনেছিল এবং কবুতর বাসা বেঁধে ডিম পেড়ে তাতে তা দিচ্ছিল। সে কবুতরের বংশধর কবুতরদের এখনো সে জায়গায় দেখা যায়।
প্রিয় নবীজি (সা.) মদিনায় গিয়ে একটি আদর্শ সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিশ্চিত করে একটি সনদ স্বাক্ষর করেন, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। এটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক সনদ হিসেবে পরিগণিত। হিজরতের এক বছরের মাথায় ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে মদিনা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরের বছর ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে মদিনার তিন কিলোমিটার দূরে ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ৬ষ্ঠ হিজরিতে নবীজি (সা.) প্রায়
দেড় হাজার সাহাবি নিয়ে ওমরাহ করতে মক্কায় আসেন। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ১০ বছরের জন্য চুক্তি সম্পাদন করে ফিরে যান। এটি বিখ্যাত ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম শান্তিচুক্তি। এই চুক্তির মূল আলোচনায় মুসলমানদের পক্ষে ছিলেন হজরত উছমান (রা.) এবং কুরাইশদের পক্ষে ছিলেন সুহাইল, চুক্তিনামাটি লেখেন হজরত আলী (রা.)।
বছর না গড়াতেই কুরাইশরা বারবার চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে। ফলে দুই বছর পর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে অষ্টম হিজরিতে মহানবী (সা.) ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে ১৭ রমজান বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। তিনি কোনো প্রতিশোধ নেননি, সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। এ বছর তিনি ওমরাহ পালন করে মদিনায় ফিরে যান। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ১০ম হিজরিতে মহানবী (সা.) হজ সম্পাদন করেন। এটি তাঁর জীবনে প্রথম হজ ও একমাত্র হজ, যা বিদায় হজ নামে পরিচিত; কারণ এর অল্প দিন পরই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। সোয়া লাখ সাহাবির উপস্থিতিতে ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে ও মসজিদে নামিরাতে এবং ১০ জিলহজ মিনার প্রান্তরে ও মসজিদে খায়েফে তিনি যে ভাষণ দেন, তা ‘বিদায় হজের ভাষণ’ হিসেবে বিখ্যাত। এটি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার সনদরূপে স্বীকৃত। এর প্রায় ৯০ দিনের মাথায় ৬৩ বছর বয়সে তিনি মদিনায় মসজিদে নববি-সংলগ্ন পূর্ব পাশে হজরত আয়িশা (রা.)-এর হুজরায় ইন্তেকাল করেন। সেখানেই তাঁর সমাধি বা রওজা মোবারক।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]