বাঙালির বড়দিন

বড়দিনে হোটেল-রেস্তোরাঁ, চার্চ, পাড়ায়-মহল্লায় আলোকসজ্জা করা হয়ফাইল ছবি

‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’—কথাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবকে উপলক্ষ করে বারবার উচ্চারণ করেন। কথাটি দেশের সব ধর্মের মানুষকে যে নাড়া দিয়েছে, তার প্রমাণ মেলে সব ধর্মের অনুষ্ঠানমালায় সবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণ থেকেই।

বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ, সুপারমার্কেট, চার্চ, পাড়ায়-মহল্লায় রংবেরঙের ঝালর ও মরিচবাতির ঝলমলে উপস্থিতি, গ্রামের খ্রিষ্টান মহল্লায় বাড়িতে বাড়িতে রাতের অন্ধকারে আলোকময় তারকার উপস্থিতি, সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বড়দিনভিত্তিক নানা পরিবেশনা তারই প্রমাণ।

উল্লিখিত বিষয়গুলো বাহ্যিক অনুষঙ্গ। সারা বিশ্বে খ্রিষ্টান পাদরিরা ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন উদ্‌যাপনের বিশেষ প্রার্থনায় বড়দিনের মর্মার্থ বা অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা করে থাকেন। তার মধ্যে কতগুলো সুনির্দিষ্ট বার্তা হলো, যিশুখ্রিষ্ট পাপময় পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। পাপী মানুষের বন্দিদশা থেকে মুক্তির বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিষ্ট। খ্রিষ্ট অনুসারীদের বিশ্বাস, যিশুখ্রিষ্ট ঈশ্বরপুত্র ও পৃথিবীর সব মানুষের মুক্তিদাতা—এই বিশ্বাসের ভিত্তির ওপরই খ্রিষ্টধর্ম প্রতিষ্ঠিত।

যিশুখ্রিষ্ট জীবদ্দশায় মৃত মানুষকে জীবিত করা, খঞ্জ মানুষকে সুস্থ করা, সাধারণ পানিকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করাসহ নানা অলৌকিক কাজ করেছেন। তৎকালীন মৌলবাদী সমাজপতিদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন তিনি।

যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে যিশুকে তৎকালীন রাজার সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দেন। ক্রুশে তুলে যিশুকে হত্যা করা হয় এবং তিন দিন পর আবার পুনরুত্থিত হয়ে তিনি স্বর্গে আরোহণ করেন।

যিশুর মা মারিয়ার স্বামী ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। নাম জোসেফ। মা ছিলেন মারিয়া (মরিয়ম)। কিন্তু ঐশ্বরিক আত্মার আবেশে কুমারী থাকা অবস্থায় মারিয়া অন্তঃসত্ত্বা হন। জোসেফ তা টের পেয়ে মারিয়াকে পরিত্যাগের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ঈশ্বর তাঁকে স্বপ্নদর্শন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে পরিচালনা করেন। এভাবে পবিত্র আত্মার প্রভাবে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই বালক যিশু অনেক পাণ্ডিত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

যিশুর আগমনের সময় থেকেই খ্রিষ্টাব্দ গণনা করা শুরু হয়। বর্তমানে চলছে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ। অর্থাৎ ২০২০ বছর সময়কাল ধরে প্রতিবছরই ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে বিশ্বের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এই দিনটিকে মহা আনন্দে উদ্‌যাপন করে থাকে। দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ক্ষমার আদর্শকে অক্ষুণ্ন রেখে মানুষে মানুষে মিলনের দিন বড়দিন; সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। খ্রিষ্টভক্তরা সেটাই বিশ্বাস করেন।

প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমের মধ্যে এ দেশে সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের পরিচিতি সংযুক্ত করার কারণে সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচার স্কুলে সব শিশুকে পড়ানো হয়। তাদের মধ্যে এই পরিচিতিবোধ সব সম্প্রদায়ের মানুষকে গ্রহণ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। সবার ধর্মীয় বিষয় ও অনুভূতিকে সহনশীলভাবে ভাবতে শেখায়।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে একটি স্মার্টফোনের কারণে নাগরিক সাংবাদিকতার সূচনা হচ্ছে। অনেক টিভি চ্যানেলের কারণে দেশের সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করছে। মানুষে মানুষে আন্তরিকতার পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বড়দিনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো আপনজনকে উপহার দেওয়া। উপহার সম্বন্ধীয় একটি বিখ্যাত গল্প লিখেছিলেন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার বিখ্যাত ছোটগল্পকার ও’ হেনরি। ছোটগল্পটির নাম ‘গিফট অব দ্য মেজাই’। বাংলায় অনুবাদ করলে তার অর্থ দাঁড়ায় ‘পণ্ডিতদের উপহার’।

ঈশ্বরের আত্মার প্রভাবে অন্তঃসত্ত্বা মারিয়াকে নিয়ে জোসেফ জেরুজালেমের বেথলেহেম নগরে পালিয়ে যান। সেই সময়ে কোনো উৎসব থাকার কারণে সেখানে কোনো সরাইখানায় তাঁদের থাকার স্থান হলো না। তীব্র শীতে তাঁরা বাধ্য হয়ে একটি গোয়ালঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মারিয়ার প্রসববেদনা অতি তীব্র হওয়ায় সেই গোয়ালঘরেই খড়কুটোর গাদায় জন্ম হয় যিশুর।

তৎকালীন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিতেরা আকাশের তারা গণনা করে একটি উজ্জ্বল তারাকে অনুসরণ করে সেই গোয়ালঘরের সন্ধান পান। তাঁরা যিশুকে দেখতে যাওয়ার সময় তাঁদের থলেতে করে নবজাতক যিশুর জন্য সবচেয়ে মূল্যবান দ্রব্য উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং শিশু যিশুকে সেগুলো দিয়ে অভিবাদন জানান। এই প্রেক্ষাপট ও পটভূমির আলোকে লেখক ও’ হেনরি যে ছোটগল্পটি লিখেছিলেন তা আমরা অনেকেই জানি।

জিম ও ডেলা নবদম্পতি। তাদের মধ্যে ছিল গভীর ভালোবাসা। জিমের সবচেয়ে দামি দ্রব্যটি ছিল তার একটি অত্যন্ত দামি ঘড়ি, কিন্তু চেইন না থাকার কারণে তা দীর্ঘদিন তার হাতে পরা হয়নি। পয়সার অভাবে চেইন কেনা হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে ডেলার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালো লাগার জিনিসটি ছিল তার মাথার লম্বা চুল, যার জন্য সে গর্ব করতে পারত। তার মনের ইচ্ছা ছিল পয়সা হলে হাতির দাঁতের এক সেট চিরুনি কিনবে। কিন্তু পয়সার অভাবে তা কেনা হয়নি।

বড়দিনের ঠিক আগের দিন জিম তার ঘড়িটি বিক্রি করে ডেলার জন্য এক সেট হাতির দাঁতের চিরুনি কিনে আনে। আর অন্যদিকে ডেলা তার মাথা ন্যাড়া করে চুলগুলো একটি পরচুলার দোকানে বিক্রি করে জিমের জন্য একটি দামি চেইন কিনে নিয়ে আসে। উপহার বিনিময়ের বিষয়টি কেউ কাউকে বলেনি।

বড়দিনের ঠিক আগের রাতে একে অপরকে উপহার দিয়েছে। কিন্তু তাদের উভয়ের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস বিক্রি করে। এত সুন্দর চিরুনি দিয়ে ডেলা কী করবে! তার তো ন্যাড়া মাথা। কী আঁচড়াবে সে! অন্যদিকে ডেলা তার চুল বিক্রির টাকা দিয়ে জিমের জন্য তার সবচেয়ে পছন্দের চেইন কিনে এনেছে। কিন্তু জিমের ঘড়ি তো আগেই বিক্রি করেছে সে।

বড়দিনে আমাদের বিনিময়টি এই নবদম্পতির উপহার দেওয়ার আচরণের মতোই হওয়া দরকার। জাতি ও সম্প্রদায়—অনুভূতির ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষে মানুষে ভালোবাসার প্রতীক হয়ে শুধু দেশ নয়, বিশ্বটাকে পুনর্গঠন করতে এসেছিলেন যিশুখ্রিষ্ট।

যিশুর ক্ষমা ও ভালোবাসার আদর্শ চর্চা করলে পৃথিবীতে থাকবে না কোনো বিদ্বেষ-বিভেদ ও হানাহানি। নানা রঙের নানা জাতি-সম্প্রদায় একাকার হয়ে সৃষ্টি হবে একটি জাতি—যার নাম হবে ‘মানবজাতি’।


রাফায়েল পালমা, সম্পাদক, ডিসিনিউজ বিডি ডট কম