মাতৃভাষায় আলাপ-আলোচনা

ধর্ম
ধর্ম

মাতৃভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলে বা আলাপ-আলোচনা করে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। মানুষের কথাবার্তা ও সংলাপ যত সুন্দর, মার্জিত, রুচিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ হবে, দেশ-জাতি-রাষ্ট্রে ততই শান্তিশৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা পরিলক্ষিত হবে। এ জন্য পারস্পরিক কথা বলার সময় সজাগ-সচেতন থাকা উচিত। বিনম্রকণ্ঠে সদালাপ সবার প্রিয়। ইসলামে মাতৃভাষায় নরম স্বরে ও সহজ, সাবলীল, বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলার দিকনির্দেশনা রয়েছে। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনায় যেসব কথা বলা হবে ও সভা-সমাবেশে যে বক্তব্য প্রদত্ত হবে, তা জাতি গঠনমূলক ও জ্ঞানসমৃদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কথা যেন কল্যাণপ্রদ হয়, এর দ্বারা নিজের অথবা অন্যের উপকার হয় সেদিকেও বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা মানুষের সঙ্গে সদালাপ করবে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ আরবিভাষী। সারা জীবনে তিনি একটি মিথ্যা কথাও বলেননি এবং অশুদ্ধ শব্দ বা বাক্যও উচ্চারণ করেননি। বাল্যকালেও তিনি বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন ও মানুষের সঙ্গে সদালাপ করতেন। তাঁর সঠিক উচ্চারণ ও অমায়িক কথাবার্তা শুনে আরবের লোকেরা অভিভূত হতো। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে নবী করিম (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর দেশে বিরাজমান সব সমস্যা দূরীভূত করে প্রথম মদিনায় শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। আরবের বিবদমান দলমত-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-সম্প্রদায়—সবাইকে নিয়ে তিনি শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় উপনীত হতে পরামর্শ বৈঠকে আলাপ-আলোচনায় বসলেন। মাতৃভাষায় সংলাপের আয়োজন করলেন। মদিনার দ্বিধাবিভক্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মনের কথা বুঝতে তাঁর তেমন বেগ পেতে হয়নি। তিনি দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনে সচেষ্ট হলেন।
দেশের জাতীয় স্বার্থে জনগণের কল্যাণকামিতায় মানবপ্রেম, ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখতে মুসলিম-অমুসলিম সব গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতার আয়োজন করলেন। প্রাণবন্ত আলোচনা সভায় তিনি সবার মাঝে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির গুরুত্ব ও বিশ্বমানবতার ঐক্য-সংহতির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তখন সবার গঠনমূলক আলাপ-আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে একটি সন্ধি চুক্তিপত্র প্রণয়ন করা হয়, যা যুগ যুগ ধরে আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তি বা ‘মদিনা সনদ’ নামে বিখ্যাত। ইসলামের ইতিহাসের এই প্রথম আলাপ-আলোচনা ও মাতৃভাষায় সংলাপের মাধ্যমে আরব দেশের সংকটময় মুহূর্তে সমঝোতাপূর্ণ জাতীয় সনদ ও লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল।
৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবী করিম (সা.) ওমরাহ পালন করতে বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরামদের সঙ্গে নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হয়ে যখন এক মাইল দূরে অবস্থিত ‘হুদায়বিয়া’ নামক স্থানে পৌঁছান, এমতাবস্থায় বিধর্মীদের পক্ষ থেকে বাধাগ্রস্ত হলেন। ইসলামের শত্রুরা ভেবেছিল মহানবী (সা.) সদলবলে যুদ্ধ করতে আসছেন। এদিকে কুরাইশ দলপতিদের পরামর্শক্রমে মক্কার লোকজন প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় যুদ্ধের জন্য রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। তখন নবী করিম (সা.)-এর কাছে একজন দূত এসে মক্কার যুদ্ধাবস্থার কথা বলল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার বক্তব্য শুনে বললেন, ‘আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি, ওমরাহ করতে এসেছি। বুদায়ল! তুমি গিয়ে কুরাইশদের বলে দাও, তারা যেন অযথা আমাদের আক্রমণ না করে। এ পবিত্র মাসে কাবা শরিফে কেউ কারও সঙ্গে যুদ্ধ করে না। আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা শান্তি চাই!’ নবী করিম (সা.)-এর এহেন শান্তি প্রস্তাব কাফের নেতাদের কাছে পৌঁছার পর মক্কায় প্রচণ্ড হইচই শুরু হয়ে যায়। পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। দুই পক্ষের এমন চরম সংকটে জনমনে সংশয় থাকলেও মাতৃভাষায় পারস্পরিক সংলাপ ও আলাপ-আলোচনায় শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়।
নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে মক্কার কুরাইশদের প্রভাবশালী নেতা উরওয়া সংকট সমাধানে প্রাথমিক আলোচনায় গেলেন ও সংলাপ-সমঝোতায় বসলেন। তিনি নবী করিম (সা.)-এর ন্যায়সংগত কথায় বিমুগ্ধ হলেন। বিশ্বশান্তির অগ্রদূতের মধুময় আলাপে দুর্বল হয়ে পড়লেন। কুরাইশরা তাঁর কথা টের পেয়ে বনু কিনানা গোত্রপতি হুলায়সকে নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে সংলাপে পাঠাল। তিনি যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তির পক্ষে কথা বললেন। তবু সংকট পুরোপুরি কাটেনি। পরে আরও কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় দলনেতা মিলে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনায় আসেন। অবশেষে সবার মতামতকে সামনে রেখে তিনি নিজের স্বার্থকে সাময়িকভাবে ছাড় দিয়ে সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে এ দ্বিপক্ষীয় সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেন। মদিনা সনদ ও হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় বাস্তবিকই নবীজীবনের কঠিন সংকটময় মুহূর্ত ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এহেন দুরবস্থায় সংকট নিরসনে ও সমস্যা সমাধানে বরাবরই ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও মাতৃভাষায় সংলাপের আয়োজন করেন। পবিত্র কোরআনেও যাবতীয় সমস্যা সমাধান ও সংকট নিরসনে আলাপ-আলোচনা আর মাতৃভাষায় সংলাপের কথা বলা হয়েছে, ‘তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কাজ সম্পাদন করে।’ (সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৩৮) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কাজকর্মে তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করো।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
সভা-সমাবেশে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনায় বা মজলিশে উপবিষ্ট হয়ে এমন উসকানিমূলক কথা বলা যাবে না, যাতে অন্যের তিরস্কার প্রচ্ছন্ন আছে এবং যা অন্যের মর্যাদার জন্য হানিকর। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির অধিকাংশ সদস্য যদি সংলাপ ও সদালাপের দিকে খেয়াল রাখেন, তাহলে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস-সহিংসতা ও প্রতিশোধপ্রবণতা বহুলাংশে লোপ পাবে এবং মানুষের মধ্যে অযথা শত্রুতা সৃষ্টি হবে না। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনায় মানুষকে আন্তরিকতাসহকারে কথাবার্তা বলতে হয়, মাতৃভাষায় ফলপ্রসূ আলাপ-আলোচনা করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে জনজীবনে কল্যাণ ও শান্তি বয়ে আনে মিষ্টি-মধুর সংলাপ। ফলে মানুষে মানুষে, দলে দলে, জাতি ও গোত্রে মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক সংলাপ ও সদালাপ স্বপ্নিল আগামী সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনের প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার গড়ে তোলে। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দলমতনির্বিশেষে সব মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত, জাতি গঠনমূলক আলাপ-আলোচনা ও প্রাণস্পর্শী কথাবার্তা বলা উচিত। বর্তমানে দেশের চরম সংকটময় মুহূর্তে ধর্মপ্রাণ জাতির কল্যাণ ও সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মাতৃভাষায় জাতীয় সংলাপ ও সদালাপের মাধ্যমে মানবতার ঐক্য ও সমঝোতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]