রমজানের ঐ রোজার শেষে

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...গানটি গাওয়া না হলে ঈদ অসম্পূর্ণ। আজও লিখছি নতুনভাবে। প্রয়োজনীয় বিবরণটি পিতা আব্বাসউদ্দিনের নিজ জবানিতে, ছাপা দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথার ১৩৩ নম্বর পৃষ্ঠায়।
ইসলামি গান, আমি ও কাজীদা
একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল-এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না? আপনি তো জানেন কীভাবে কাফের-কুফর বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙেক্তয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! যদি ইসলামি গান লেখেন, মুসলমানের ঘরে ঘরে উঠবে আপনার জয়গান।’
তিনি বললেন, ‘আব্বাস, ভগবতীবাবুকে বলে তার মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারব না।’ ভগবতী ভট্টাচার্য, অর্থাত্ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল-ইনচার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না, ওসব গান চলবে না।
ছয় মাস পর। দুপুরে বৃষ্টি, অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল ঘরে গিয়েছি। দেখি, বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ী ও বৃদ্ধ ভগবতীবাবু রসালো গল্প করছেন। সালাম দিতেই বৃদ্ধ বললেন: ‘বসুন, বসুন।’ বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, বলি। সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা, একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, বিক্রি না হলে আর নেবেন না, ক্ষতি কি?’ হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’
পাশের ঘরে কাজীদা। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই লিখে ফেললেন: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। তখনই সুরসংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন: ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’।
গান দুখানা লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড। কাজীদার ধৈর্য মানছিল না, চোখেমুখে কী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল! তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দুখানা তখনো মুখস্থ হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই আমার প্রথম ইসলামি রেকর্ড। দু’মাস পর ঈদুল ফিতর। শুনলাম, গান দুখানা তখন বাজারে বের হবে।
ঈদের বাজার করতে ধর্মতলার দিকে গিয়েছি। বি এন সেন, অর্থাত্ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিদার সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, আমার দোকানে এস।’ এক ফটোগ্রাফার ডেকে নিয়ে এসে বসলেন, ‘এর ফটোটা নিন।’ আমি অবাক! বললাম, ‘ব্যাপার কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমার একটা ফটো নিচ্ছি, ব্যস, আবার কী?’
ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলাম। কলকাতায় ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছি। ট্রামে একটি যুবক পাশে গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। অবাক হলাম। এ গান কী করে শুনল! অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছি, মাঠে বসে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠল, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। বিভূতিদার দোকানে গেলাম। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। সন্দেশ, রসগোল্লা, চা এনে বললেন, ‘খাও।’ গান দুটো এবং আর্ট পেপারে ছাপানো বিরাট ছবির একটা বান্ডিল সামনে রেখে বললেন, ‘বন্ধুবান্ধবের কাছে বিলি করে দিও। সত্তর-আশি হাজার ছাপিয়েছি, ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি। আর এই দেখ, দু’হাজার রেকর্ড এনেছি তোমার।’
আনন্দে-খুশিতে মন ভরে উঠল। ছুটলাম কাজীদার বাড়ি। তিনি রিহার্সাল রুমে। দাবা খেলায় মত্ত। আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে-’ আর বলতে দিলাম না, পা ছুঁয়ে তার কদমবুসি করলাম।
এবার আমার কথা
এ গান নিয়ে আরও লেখা হবে কোনো দিন গল্পে, উপন্যাসে। আজ নয় অন্য কোন দিন, এ কারণে যে এই গানটি মুসলমানদের জাগিয়ে তুলেছিল। ভুলেই ছিলাম আমাদের পরিচয়, যাতে মূর্ত স্বতন্ত্র বীণার তারে গুঞ্জরিত কাব্য সুধা ও সংগীত। নজরুল ও আব্বাসউদ্দিন তা জাগিয়ে তুলেছিলেন।
গানের গভীরে কী বলতে চেয়েছেন কবি তাঁর মাত্র দশ লাইনের গানে, সেটাই বিবেচ্য। গান শুনি, ভেতরে ঢুকি না।
শোন আসমানি তাগিদ
অর্থ: আল্লাহ্তা’য়ালার বয়ান, অর্থাত্ কোরআন শরিফে কী রয়েছে। মানবতার স্বার্থে নিজকে বিলিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত কি না, এটাই আসমানি তাগিদ। পুঞ্জীভূত সম্পদের ভার, দিনে দিনে যা বেড়েই চলছে, তাতে বাঙালির নিদ্রা ভঙ্গ হবে কি? নিদ্রা থেকে জাগরিত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লে, কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে কি? জাকাত না দিলে মুসলমানদের এই মুর্দা বেশ ঘুঁচবে না।
কবির কথায়, ‘দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ’। জাকাত নিয়েই নজরুলের একাধিক গান। মনে পড়বে কাজী নজরুল ইসলাম ঈদগাহ নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা ও গান। ঈদগাহ নিয়েই তাঁর স্বপ্নের বিস্তার। এটি শাহাদাতের ঈদগাহ, যেখানে মুসলমান প্রস্তুত শাহাদাতের জন্য।
যে ময়দানে সব গাজি মুসলিম হয়েছে শহীদ।
শহীদ হতে চাইবে না যারা, ঈদগাহ তাদের জন্য নয়। কারণ এ পৃথিবীর সম্পদ আহরণ ও ভোগ নিয়েই তারা ব্যস্ত। ঈদগাহের মাঠে ঢুকতেই কয়েক হাজার প্রার্থী, বেশির ভাগ অন্ধ, লাচার, তারপরেও হাজার দুখি মানুষের মিছিল। এই কয়েক হাজার মানুষকে সম্পদ বিলানো কোনো ব্যাপারই না। জাকাত দিতে প্রস্তুত সব মুসলমান, এমনকি গরিবেরাও। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। কাজটি করতে পারলে এবং আল্লাহ্ সহায় হলে প্রার্থী কমতে থাকবে। এমন দিন নিশ্চয়ই আসবে, যখন জাকাত নেওয়ার কেউ থাকবে না।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন, হাত মিলাও হাতে
শাহী মঞ্জিলে থাকব না। রসুল (সা.) ছিলেন না। দারিদ্র্যই ছিল তাঁর অহংকার। গরিবদের মতো থাকব, সাধারণ পোশাক। জীবন নিয়োজিত হবে গরিবের স্বার্থে। চিন্তা হবে আগামী ঈদ কেমন করে তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। বড়মানুষি ও বড়লোকি পরিহার করে চলব। বিলাসিতা থেকে হব মুক্ত। দোস্ত দুশমন ভুলে যাব। আমরা কি আজও ঈদের দিন তা ভুলে যাই? দোস্ত ও দুশমনের ফারাক বেড়েই চলে।
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ
অর্থাত্: চাই ইসলামের মুরিদ হতে। রাজনৈতিক দল বা পীর সাহেবানের মুরিদ নয়। শক্ত করে ধরব আল্লাহ্র রজু। মুর্শিদ ও পীর: হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
ঢাল্ হূদয়ের তোর তশ্তরীতে ‘শির্ণী তৌহিদে’র
‘তৌহিদ’ আল্লাহ্র একত্ববাদ, তাঁর ‘ওয়াহ্দানিয়াত’। আল্লাহর সৃষ্টির সঙ্গে একাত্মবোধ, মমত্ববোধ, প্রগাঢ় ভালোবাসা। কারও প্রতি নয় বিদ্বেষ, এটিই তৌহিদের শির্ণী। ঈদের মাঠে কোলাকুলি করি। নিজকে বিলিয়ে দিই। এর চেয়ে আর কোনো আনন্দ জীবনে খুঁজে পাইনি ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত। তৌহিদের শির্ণীর জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুত। এখনই পাব প্রিয় হজরতের দাওত। শেষ লাইনটি লক্ষ করুন:
তোর দাওত্ কবুল করেব হজরত হয় মনে উম্মীদ
মদিনা শরিফে হজরতের দাওত-এ এই অধম শরিক। কদিন আগে। লিখেছি এ নিয়ে: ‘রসুল (সা.)-এর পদপ্রান্তে’। সবুজ গম্বুজের নিচে রওজাপাকের সামনে আসন গেড়ে বসি। কেউ সরায় না। নজরুল, আব্বাসউদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, তিন নায়েবে রসুল ঈপ্সিত দরবারে হাজিরা দিতে পারেননি। তাতে কী? তাঁদের প্রতিনিধি উপস্থিত। এক হাজার বছর পরেও প্রতিনিধিরা থাকবেন চোখের পানির সয়লাবে। কবির মনের এই উম্মীদ নিশ্চয়ই কবুল করেছেন হজরত।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।