রাসুল (সা.)–এর পিতামহের প্রতি ফুফুর শোকগাথা

ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি। মানবতা নাজুক পর্যায়ে। মানুষ তার স্রষ্টাকে ভুলে গিয়েছিল। আপনাকে, আপনার ভবিষ্যৎ ও পরিণতি সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছিল। মানুষের দিল-দেমাগ হারিয়ে বসেছিল অতলে। পরকাল নিয়ে ছিল না কোনো চিন্তা। একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না যে এক আল্লাহর ইবাদত করবে। শিরক করবে না। মানবতার জন্য এক দরদি বন্ধুর প্রয়োজন পড়ে ছিল। যিনি ভয়াল পরিণতির জন্য অস্থির হয়ে উঠবেন। আঁধার থেকে নিয়ে আসবেন আলোর পথে। অনিবার্য প্রয়োজন দেখা দিল তখন একজন নবীর। নবী প্রেরিত হলেন ধরাধামে।


বহুকাল আগে মহানবীর পূর্বপুরুষদের শ্রেষ্ঠ সন্তান নবী ইব্রাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবার দেয়াল তুলতে তুলতে প্রার্থনা করেছিলেন তাঁদের বংশে নবী প্রেরণের। সেই নবী বা প্রেরিত পুরুষ যেন সবাইকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন এবং দিগভ্রান্ত মানুষকে সুপথে আনেন—তাই ছিল পিতা-পুত্রের আকুতি। এ কথার নজির রয়েছে কালাম শরিফে।


বলা হচ্ছে, ‘স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবাঘরের প্রাচীর তুলেছিল, তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ কবুল করো; নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত করো এবং আমাদের বংশধর থেকে তোমার এক অনুগত উম্মত করো। আর আমাদের ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট একজন রাসুল পাঠাও, যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত (আবৃত্তি) করবে, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা বাকারা: ১২৭-২৯)

মহানবী (সা.) আরব দুনিয়ায় এলেও অল্প দিনের মধ্যে সব মানবতার করুণাধারা হয়ে উঠেছিলেন। এর স্বীকৃতি পবিত্র কোরআনে আছে, ‘আমি তোমাকে পৃথিবীর রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)


নবীজীবনের নানা অধ্যায় আমাদের সামনে উন্মোচিত হওয়া দরকার। কেননা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তুলনাহীন এক পুরুষ তিনি। আঞ্জাম দিয়েছেন নানা কাজের। কখনো ব্যক্তি হিসেবে, কখনো নবী হিসেবে। এ কথা তিনি স্মরণও করিয়ে দিয়েছেন অনুসারীদের। ‘আমি তোমাদের মতো একজন মানুষ, শুধু পার্থক্য আমার ওপর ওহি নাজিল হয়।’ (সুরা হা-মিম সিজদা: ০৬)


নবীর পরিবারে কবিতার চর্চা
আমরা নবীর জীবনের নানা বিষয় জানি ও বুঝি। কবিতা ও সাহিত্যে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কী তাঁর ভূমিকা ছিল, সেটাও একালে অনেকের অজানা নয়। উৎসুক পাঠকমাত্রই সেটার খোঁজ জানেন। সেই জানার মধ্যে উদগ্র বাসনা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উদয় হয়েছে—মহানবী (সা.)–এর পরিবারে কি কবিতাচর্চার কোনো রেওয়াজ ছিল?


এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাই, স্ত্রী হজরত আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.), জামাতা আলী ইবন আবু তালিব (রা.) ও কন্যা ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (রা.) কবিতাচর্চার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এ ছাড়া পেছন ফিরে দেখি, মহানবীর বংশের গোড়ার লোকেরাও কবিতাচর্চায় এগিয়ে ছিলেন। মেয়েদেরও দেখা যাচ্ছে কবিতাচর্চায় পারদর্শী হিসেবে।
এ নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ কম। এ প্রবন্ধে আমরা একটি ক্ষুদ্র অংশ তুলে ধরব। মহানবী (সা.)–এর দাদা যখন ইন্তেকাল করেন, তাঁর আগে কন্যাদের জড়ো করে তিনি মার্সিয়া বা শোকগাথা শুনতে চেয়েছিলেন। সেটাই আমরা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করতে চাই।

মুত্তালিবকন্যাদের শোকগাথা
আবদুল মুত্তালিব ছিলেন নবীজির দাদা। তাঁর কন্যারা সম্পর্কে নবীজির ফুফু। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন আরবের প্রতিভাধর নারী।
সিরাত বা মহানবীর জীবনচরিত বিশেষজ্ঞ ইবনে হিশাম তাঁর গ্রন্থে ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ইবনে ইসহাক বলেন, ‘আব্বাস ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মা’বাদ ইবনে আব্বাস তাঁর পরিবারের কারও সূত্রে আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুকালে রাসুল (সা.)-এর বয়স ছিল আট বছর।’


ইবনে ইসহাক বলেন, ‘সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (র.)-এর পুত্র মুহাম্মদ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে যখন আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু আসন্ন হলো এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, তখন তাঁর সব কন্যাকে একত্র করলেন। তাঁর সর্বমোট ছয় কন্যা ছিলেন। তাঁদের নাম যথাক্রমে সাফিয়্যা, বাররা, আতিকা, উম্মে হাকিম আল বায়শা, উমায়মা ও আরওয়া। তিনি তাঁদের বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা কে কী বলে বিলাপ করবে বলো, আমি মরার আগে সেটা একটু শুনে যেতে চাই।’
ইবনে হিশাম বলেন, ‘আমি কবিতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন কোনো কবি দেখিনি, যিনি এসব শোকগাথা সম্পর্কে জানেন। তবে মুহাম্মদ ইবনে সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব থেকে কিছু কবিতা বর্ণিত হয়েছে, যা আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি।’


সাফিয়্যার শোকগাথা
ছয় কন্যার মধ্যে সাফিয়্যা রচিত শোকগাথাটি এই—
‘কবরের পাশ দিয়ে চলে গেছে যে রাস্তা,
সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে শোকে মুহ্যমান এক নারী;
মহান ব্যক্তির জন্য তার কান্নাধ্বনিতে
ঘুম ভেঙেছে আমার।
তার বিলাপ শুনে চোখের পানি
কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিরল মুক্তার মতো।
এমন বিলাপ মান্যবর এক ব্যক্তির প্রতি
যিনি মিথ্যা দাবি করে হননি অন্য কোনো বংশের লোক।
ছিলেন আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অতিউত্তম,
শায়বার প্রতি মহাদানশীল, আরও আরও গুণের অধিকারী।
মুত্তালিব যে পিতার সন্তান, সে তো বড় ভালো লোক।
বদান্যতায় কে আছে তাহার সমান।
আমি বিলাপ করছি সেই ব্যক্তির জন্য
সঙ্গীদের পেছনে নয়, থাকতেন সমুখে।
রণাঙ্গনে তুমুল বীরত্বে শত্রুকে করতেন মোকাবিলা।
ছিলেন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং বংশীয়।
এই শোকগাথা তাঁর জন্য যিনি ছিলেন দানবীর, দরাজহস্ত,
সৌন্দর্য ও বীরত্বে সমাসীন, নিজের গোত্র—
যাকে গ্রাহ্য করেছে প্রশংসার পাত্ররূপে।
শোকতাপ করছি এমন ব্যক্তির, যিনি উঁচু বংশের
সুদর্শন চেহারাঅলা বহুগুণে গুণান্বিত।
ছিলেন মন্বন্তরে আর্তজনের প্রতি মহাদানশীল।
শোক তাঁর প্রতি, যিনি অতিশয় ধৈর্যশীল ও সম্মানিতদের দলে,
মর্যাদা ও বাহাদুরিতে শ্রেষ্ঠ গোত্রসমূহের পৃষ্ঠপোষক।
বিধির বিধান যদি হতো—পুরোনো ইজ্জত
সম্মানের বশবর্তীলোক থাকবেন অমর;
তবে নিশ্চয়ই আপনিই হতেন তা।
কিন্তু তাতো হবার নয় পিতা!’


এভাবে একে একে বাকি ছয় কন্যা শোকগাথা আবৃত্তি করলেন। ইবনে হিশাম ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এরপর আবদুল মুত্তালিবের বাক্‌শক্তি রহিত হয়ে যায় এবং তিনি কন্যাদের মর্সিয়া বা শোকগাথা শুনে মাথা নেড়ে ইশারা করে বলেন, ঠিক আছে, এভাবেই বিলাপ ও শোক প্রকাশ করো।
আবদুল মুত্তালিবের প্রিয় পুত্র ছিলেন আবদুল্লাহ। তাঁরই উরশে আলো করে এসেছিলেন আহমদে মুজতাবা মহানবী মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ (সা.)।


সূত্র:
০১. ইবনে হিশাম: সিরাতুন নবী (সা.)
০২. সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নাদভি: নবীয়ে রহমত
০৩. ড. আবদুল জলিল: কবি ও কবিতা সম্পর্কে রাসুল ও সাহাবিদের মনোভাব
০৪. কবিতার অনুবাদ বর্তমান লেখকের নিজস্ব


* মহিউদ্দীন মোহাম্মদ: কবি ও আরবি সাহিত্যের গবেষক