লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক

.
.

আরবি ‘হজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নিয়ত করা, কোনো পবিত্র স্থানে গমনের ইচ্ছা পোষণ করা, জিয়ারতের উদ্দেশে প্রতিজ্ঞা করা প্রভৃতি। নির্দিষ্ট দিনে কাবাগৃহ এবং তৎসংলগ্ন কয়েকটি সম্মানিত স্থানে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুসারে অবস্থান করা, জিয়ারত করা ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করাই হজ। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম রোকন হজকে ফরজ ঘোষণা করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা মক্কায়, এটা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি। এতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। যেমন মাকামে ইবরাহিম। এবং যে কেউ সেথায় প্রবেশ করে, সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই গৃহের হজ করা তার অবশ্যকর্তব্য।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭) এখানে সামর্থ্যবান মুসলমানদের দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত হজের অত্যাবশ্যকীয় বিধানগত মর্যাদা অনুধাবন করা যায়। পবিত্র কোরআনে হজের বহুবিধ কল্যাণ ও উপকারিতার বর্ণনায় সমৃদ্ধ সূরা আল-হজ নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা অবতীর্ণ হয়েছে।
আদিমানব ও প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) আল্লাহর আদেশে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন এবং বায়তুল্লাহ শরিফে হজ আদায় করেন। সাড়ে চার হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) কাবাঘর পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত করে দুনিয়াবাসীর উদ্দেশে হজের আহ্বান করেছিলেন; স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে এ নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘(হে ইবরাহিম!) মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে, যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে... তারা যেন প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ২৭-২৯)
৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে নবম হিজরিতে হজের বিধান ফরজ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ওহে লোকেরা! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন, অতএব তোমরা হজ পালন করো।’ (মুসলিম)। পরের বছরে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে নবী করিম (সা.) হজ আদায় করেন। তিনি যেখানে, যে সময়ে, যে তারিখে, যে নিয়মে যেসব বিধিবিধান পালন করেন, প্রতিবছর ৮ থেকে ১৩ জিলহজ মক্কা মোকাররমা এবং এর ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্দিষ্ট নিয়মে সেভাবেই হজ পালিত হয়। সুদীর্ঘ সময় পরে এবার শুক্রবার ‘আকবরি’ হজ পালিত হচ্ছে। পবিত্র জুমাবার হজের দিন নির্ধারিত হওয়ায় সৌদি আরবসহ সারা বিশ্বে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হজ পালনের ও সরাসরি হজ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতারা শুক্রবারের আকবরি হজকে বিশেষ ফজিলত ও আল্লাহর অশেষ রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
১৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে হজের ইহরাম পরিহিত উম্মতে মুহাম্মদি গভীর ধর্মীয় আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাকা’ অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আপনার মহান দরবারে হাজির, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, নিয়ামত এবং সব রাজত্ব আপনারই, আপনার কোনো শরিক নেই—এ তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর দিন মক্কা থেকে মিনায় এসে নামাজ আদায় করেন।
এরপর মিনা থেকে হাজিরা উচ্চ স্বরে তালবিয়া পাঠ করতে করতে ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হন। জোহরের নামাজের আগে মসজিদে নামিরার মিম্বারে দাঁড়িয়ে হজের খুতবা দেওয়া হয়। এরপর জোহর ও আসরের ওয়াক্তের মধ্যবর্তী সময়ে জোহর ও আসরের কসর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয়। সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত হাজিরা আরাফাতেই অবস্থান করে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন। হজের দিনে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের প্রতিদানে হাজিদের নিষ্পাপ ঘোষণা করা হয়। আল্লাহ তাআলা আরাফার দিনে ফেরেশতামণ্ডলীকে ডেকে বলেন, ‘হে ফেরেশতাগণ! তোমরা লক্ষ করো, আমার বান্দারা কী প্রকারে বহু দূরদূরান্ত থেকে এসে আজ আরাফাত মাঠে ধুলাবালুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তোমরা সাক্ষী থাকো, যারা আমার ঘর জিয়ারত করতে এসে এত কষ্ট স্বীকার করছে, নিশ্চয়ই আমি তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিলাম।’ (বুখারি)। সঠিকভাবে হজ আদায়কারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বিশুদ্ধ মকবুল একটি হজ পৃথিবী ও এর মধ্যকার সব বস্তু থেকে উত্তম। বেহেশত ব্যতীত অন্য কিছুই এর বিনিময় হতে পারে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজ মানুষকে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দেয়। বিশ্বের সব মুসলমান হজের মৌসুমে মক্কা শরিফে একতাবদ্ধ হন এবং ইহরাম অবস্থায় তালবিয়া পাঠ, সালাত আদায়, কাবাঘর তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদে চুম্বন বা স্পর্শ করা, সাফা ও মারওয়ায় সায়ি করা, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ, মুজদালিফায় রাত্রিযাপন ও মাথা মুণ্ডানো প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করেন। হজ মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে থাকে এবং সমাজব্যবস্থায় ন্যায়নীতির ভাবধারা চালু হয়। হজই একমাত্র ইবাদত, যা পালনের সময় দুনিয়ার সব মায়া-মোহাব্বত বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। একজন হাজি পার্থিব সব ধন-সম্পদ, স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে কাবাগৃহে সমবেত হন। হজ মুসলমানদের মনে আল্লাহর আনুগত্যের স্বীকৃতি, হৃদয়ের পবিত্রতা, ইমানের শক্তি বৃদ্ধি ও আধ্যাত্মিক জীবনের চরম উন্নতি সাধনের দ্বারা অন্তরে পারলৌকিক সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]