হজ ও মদিনা শরিফ জিয়ারত

মদিনায় নবীজি (সা.)-এর রওজা শরিফ
মদিনায় নবীজি (সা.)-এর রওজা শরিফ

মদিনা মুসলমানদের প্রাণের ভূমি। মদিনা হলো নবীজি (সা.)-এর শহর; শান্তির নগর। রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘যে আমার রওজা জিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল।’ (সহিহ মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, যে হজ করল কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না; সে আমার প্রতি জুলুম করল। (তিরমিজি) ফকিহগণের মতে, হাজির জন্য মদিনা শরিফ জিয়ারত করা সুন্নত। আল্লামা ইউসুফ ইসলাহি আসান ফিকাহ গ্রন্থে লিখেছেন, হাজি সাহেবদের জন্য রওজা শরিফ জিয়ারত করা ওয়াজিব।
ইসলাম-পূর্ব যুগে মদিনার নাম ছিল ইয়াস্রিব। রাসুলে কারিম (সা.)-এর হিজরতের পর এই শহরের নাম হয় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। সংক্ষেপে এখন বলা হয় মদিনা। মদিনা শরিফ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আশ্রয়ভূমি; প্রেম, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্থান এবং সত্যনিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার অদ্বিতীয় কর্মক্ষেত্র। মদিনাবাসীর ব্যবহার অতি মধুর, তাঁদের বাক্যালাপ অতি মিষ্ট এবং তাঁদের সঙ্গ অতি পবিত্র। সর্বদা সতর্ক থাকবেন যেন মদিনা শরিফে কোনোরূপ বেয়াদবি না হয়। মদিনাবাসীকে সব সময় ইজ্জত ও সম্মান প্রদর্শন করবেন।
মদিনায় অবস্থানকালে প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হচ্ছে মসজিদে নববিতে হাজিরা দেওয়া এবং সেখানে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া। এখানে একাদিক্রমে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে নববিতে জামাতের সঙ্গে পড়ার অবশ্যই চেষ্টা করবেন। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে আর কোনো নামাজ কাজা করেনি, সে নিফাক (মোনাফিকি) আর দোজখের আজাব থেকে নাজাত পাবে।’ মসজিদে নববিতে এক রাকাত নামাজের সওয়াব পঞ্চাশ হাজার রাকাত নামাজের সমান।
মসজিদে নববির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নবীজির রওজা শরিফ। হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরার মধ্যে তাঁর পবিত্র মাজার শরিফ অবস্থিত। তাঁরই পাশে হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত উমর (রা.)-এর মাজার। (এর পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি আছে, এখানে হজরত ঈসা (আ.)-এর সমাধি হবে)। রওজা শরিফ জিয়ারতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর তাঁর রওজা মোবারক জিয়ারত করল, সে যেন রাসুল (সা.)কে জীবদ্দশায় দর্শন করল।
মসজিদে নববির পশ্চিম পাশের প্রবেশপথকে বাবুস সালাম বলা হয়। এ দরজা দিয়ে মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতে হয়। মসজিদে নববির পূর্ব পাশের বহির্গমন দরজাকে বাবে জিবরাইল বলা হয়। এখানে হজরত জিবরাইল (আ.) ওহি নিয়ে এসে প্রায়ই অপেক্ষা করতেন। তাই এ নাম হয়েছে।
রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুলে কারিম (সা.)-এর মিম্বর পর্যন্ত স্বল্প পরিসরের স্থানটুকুকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এটি দুনিয়াতে একমাত্র জান্নাতের অংশ। এই স্থানে স্বতন্ত্র রং (ধূসর সাদাটে) কার্পেট বিছানো থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার রওজা ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান।’ এখানে প্রবেশ করা মানে জান্নাতে প্রবেশ করা। রাসুলে কারিম (সা.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজের ইমামতি করতেন, সেই মেহরাবকে মেহরাবুন নবী বা নবীজি (সা.)-এর মিহরাব বলা হয়। হজরত জিবরাইল (আ.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন, সেখানকার মেহরাবটি মেহরাবে জিবরাইল বা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মিহরাব নামে পরিচিত।
প্রথম দিকে হুজুর (সা.) একটি খেজুরগাছের খাম্বার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জুমার দিনে খুতবা দিতেন। যখন মিম্বর বানানো হলো, তখন হুজুর (সা.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা বয়ান করতেন। এই খাম্বা হুজুর (সা.)-এর বিচ্ছেদের কারণে এমন করে কান্না শুরু করে যে মসজিদের সব লোক স্তম্ভিত হয়। হুজুর (সা.) মিম্বর থেকে নেমে এসে খাম্বার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে সংবর্ধনা দিলে সে শান্ত হয়। পরে সেই খাম্বাটিকে দাফন করা হয়।
আবু লুবাবা নামক এক সাহাবির তওবা কবুল হয় যেখানে, সেটি ‘উস্তোয়ানা আবুলুবাবা (রা.)’ হিসেবে পরিচিত।
ইতিকাফের সময় হজরত মা আয়েশা (রা.) যে জায়গায় থেকে জানালার মধ্য দিয়ে নবীজি (সা.)-এর খেদমত করতেন, তা হচ্ছে ‘উস্তোয়ানা আয়েশা (রা.)’। ইতিকাফের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য খাট-বিছানা যেখানে পাতা হতো, তা হচ্ছে ‘উস্তোয়ানা সারির’। হজরত আলী (রা.) যেখানে দাঁড়িয়ে নবীজিকে পাহারা দিতেন, তা হচ্ছে ‘উস্তোয়ানা আলী (রা.)’। আর ‘উস্তোয়ানা ওফুদ’ হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে বসে রাসুলে কারিম (সা.) দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন।
মসজিদে নববির পূর্বদিকে অবস্থিত জান্নাতুল বাকি গোরস্থানে অসংখ্য সাহাবা, আউলিয়া, বুজুর্গ এবং ধার্মিক মুসলমানদের মাজার রয়েছে। এর মধ্যে হজরত ফাতিমা (রা.), হজরত উসমান (রা.), উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.), হুজুর (সা.)-এর চাচা হজরত আব্বাস (রা.), হুজুরের ছাহেবজাদা হজরত ইব্রাহিম (রা.), হজরত হাসান (রা.), হজরত জয়নুল আবেদিন (রা.), হজরত উসমান ইবনে মজউন (রা.), হুজুরের ছাহেবজাদি হজরত রোকাইয়া (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), হজরত সাআদ ইবনে আবিওয়াক্কাছ (রা.), হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হজরতের দুধমা হালিমা সাদিয়া (রা.), ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রা.), ইমাম জাফর সাদিক (রা.), হজরত বাকির (রা.) প্রমুখের মাজার শরিফ উল্লেখযোগ্য। হুজুর (সা.) প্রায়ই শেষ রাতে জান্নাতুল বাকিতে যেতেন এবং দোয়া করতেন।
পবিত্র মদিনা শহরের ঠিক উত্তর-পূর্ব দিকে ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড় অবস্থিত। মসজিদে নববি হতে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এই ওহুদ প্রান্তরেই বিধর্মীরা নির্মমভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দন্ত মোবারক শহীদ করে। এই রণক্ষেত্রে নবীজির চাচা মহাবীর হজরত হামজা (রা.) এবং হজরত আকিল ইবনে উমাইয়া (রা.)সহ সত্তরজন সাহাবা শহীদ হয়েছিলেন। হজরত আমির হামজা (রা.) ও হজরত আকিল (রা.)কে একই কবরে দাফন করা হয়। এখানে একটি মসজিদ আছে। শহীদানদের মাজার জিয়ারত করা উচিত।
মসজিদে কিবলাতাঈন হচ্ছে সেই মসজিদ, যেখানে বসে তখনকার কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে জোহরের নামাজ পড়ার সময় নবীজির কাছে ওহি নাজিল হয় যে ‘আপনি এখনই এই অবস্থায় কাবার দিকে কিবলা করে নামাজ সমাধা করুন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) মাত্র দুই রাকাত ফরজের ইমামতি করেছেন। আদেশ পাওয়ামাত্র তিনি কাবা শরিফের দিকে ঘুরে বাকি দুই রাকাত নামাজ সমাধা করেন।
মসজিদে কোবা হচ্ছে ইসলাম জগতের সর্বপ্রথম মসজিদ। এটা হজরত রাসুলে কারিম (সা.)-এর নিজ হাতে তৈরি। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসার পরই মসজিদে কোবার সম্মান। এখানে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লে এক উমরাহ্র সওয়াব পাওয়া যায়। খন্দক প্রান্তরের পাশে অল্প পরিসর স্থানে কাছাকাছি ছয়টি মসজিদ আছে। এগুলো হচ্ছে মসজিদে ফাত্তাহ, মসজিদে সালমান ফারসি (রা.), মসজিদে আবু বকর সিদ্দিক (রা.), মসজিদে উমর (রা.), মসজিদে আলী (রা.) ও মসজিদে ফাতিমা (রা.)।
বনিসালেম মহল্লায় অবস্থিত মসজিদে জুমুআ মসজিদেই হজরত রাসুলে কারিম (সা.) প্রথম জুমার নামাজ পড়েন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) যে মসজিদে ঈদের জামাতে ইমামতি করেছেন এবং একসময় বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্কার (বৃষ্টি প্রার্থনা) নামাজ পড়েছিলেন, তা মসজিদে গামামা নামে পরিচিত। গামামা হচ্ছে মেঘ। এ জন্য এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে মসজিদে গামামা। বদরের যুদ্ধের সময় হজরত রাসুলে কারিম (সা.) মসজিদে সাকিয়ায় নামাজ পড়েছিলেন এবং মদিনাবাসীর জন্য দোয়া করেছিলেন।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]