'আল কুদস' মুসলমানদের প্রথম কিবলা

‘কুদস’ অর্থ পবিত্র। ‘আল কুদস’ হলো ফিলিস্তিনের জেরুজালেম পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত পবিত্র মসজিদ, যা ‘মসজিদুল আকসা’ ও ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত। মুসলমানদের কাছে বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা সব সময় সম্মানিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মিরাজ রজনীতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বাইতুল মুকাদ্দাস প্রথম সফর করেন, যা ইসরা নামে পরিচিত। (সুরা-১৭ বনি ইসরাঈল, আয়াত: ১)। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজ গমনের সময় এই মসজিদে সব নবী রাসুলের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এতে তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ সব নবীর ইমাম ও ‘সাইয়েদুল মুরসালিন’ সব রাসুলের সরদার হিসেবে স্বীকৃত হন। এ এলাকা অসংখ্য নবী রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবী রাসুলের সমাধি রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণস্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র। এই পবিত্র ভূমির ভালোবাসা প্রোথিত রয়েছে প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের গভীরে।

হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর, তদীয় পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)–এর সন্তান হজরত ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে আল আকসা মসজিদটি নির্মাণ করেন। অতঃপর তদীয় পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)–এর বংশধর হজরত দাউদ (আ.)–এর সন্তান হজরত সুলাইমান (আ.) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি রমাদান মাসের শেষ শুক্রবার জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রথমে ‘কাবা’ কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ স্থাপনের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ওহি লাভ ও নবুওয়ত প্রকাশের সময় বাইতুল মুকাদ্দাসই কিবলা ছিল। নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই কিবলা পরিবর্তন হয়ে পুনরায় ‘কাবা’ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। মদিনা শরিফে মসজিদুল কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ রয়েছে। ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘তাহবিলে কিবলা’ বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৪২-১৫১)। এই থেকেই ইসলামের দ্বিতীয় কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত হয়। হাদিসে আছে, ‘কাবা শরিফ তথা মসজিদুল হারামে নামাজে এক লক্ষ গুণ সওয়াব, মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে নামাজে ৫০ হাজার গুণ সওয়াব, বাইতুল মুকাদ্দাসে নামাজে ২৫ হাজার গুণ সওয়াব।’

খলিফাতুল মুসলিমিন ফারুকে আজম হজরত উমর (রা.)–এর খিলাফতকালে ৬৪৮ সালে বাইতুল মুকাদ্দাস ও জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহশালার সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (র.) পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে খ্রিষ্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে; অল্প সময়ের মধ্যে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দাঙ্গা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এ সময় ব্রিটিশরা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে, বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে জায়নবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে মুসলমানদের প্রতি ইহুদিদের জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে, যা আজও চলছে।

ইসরায়েল নামক অবৈধ রাষ্ট্র ১৯৬৭ সালে ‘মসজিদুল আকসা’ জবরদখল করে। এরপর থেকে মুসলিম জনগণ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সূচনা করে। ইসরায়েল একের পর এক মুসলিম এলাকা জবরদখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত এবং হত্যা–গুম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলিদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা সচেতন মুসলমানদের সংগ্রামী প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে পরিপূর্ণভাবে সফল হতে পারেনি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণ ফিলিস্তিনি মুসলিমদের এ প্রতিরোধ আন্দোলন সমর্থন করেছে। ১৯৭৯ সাল থেকে ‘আল আকসা’ মসজিদ মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর রমাদান মাসের শেষ দশকের শুক্রবার ‘আল কুদস’ দিবস পালন করে। তখন থেকে সারা বিশ্বে দিনটি মুসলিম মুক্তির প্রতীকরূপে পালিত হয়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]