কচ্ছপের ফটোগ্রাফি

.
.

অনেক দিন থেকেই কচ্ছপ দেখছে, তাকে কেউ পাত্তা দেয় না। কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত পায় না বলে তার মন-মেজাজ ভালো নেই। রাস্তাঘাটে দেখা হলে কেউ জিজ্ঞেসও করে না, ভাই কেমন আছেন? জুনিয়র পোলাপানও শিস বাজিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাই অনেক ভেবে কচ্ছপ ঠিক করল, সে একটা দামি ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনবে। আজকাল কাঁধে দামি ক্যামেরা না থাকলে পাত্তা পাওয়া যায় না। ক্যামেরা থাকলে যেকোনো অনুষ্ঠানে সবাই দাওয়াত দেবে। কচ্ছপ একটা ক্যামেরা কিনে ফেলল। তারপর ক্যামেরাটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেশ ভাব নিয়ে হাঁটতে লাগল জঙ্গলে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সত্যি সত্যি জঙ্গলের সবাই তাকে পাত্তা দেওয়া শুরু করল। জলহস্তি এসে বলল, ‘আমার একটা ছবি তুলে দে না।’ কচ্ছপ কপাল কুঁচকে বলল, ‘তোমার ছবি তুলতে অনেক ওয়াইড লেন্স লাগবে। লেন্সটা বাসায় রেখে এসেছি।’ জিরাফ বলল, ‘ভাই, আমার একটা ছবি তুলে দে। ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার দিতে পারছি না। বডি এলে মাথা আসে না। মাথা এলে বডি আসে না।’ কচ্ছপ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাবজেক্ট হিসেবে তুমি ভেজাইল্লা। তোমার ঠ্যাং ফোরগ্রাউন্ডে, বডি মিডগ্রাউন্ডে আর মাথাটা ব্যাকগ্রাউন্ডে। সময় লাগবে। তা ছাড়া আজ প্রোফাইল পিকচার তোলার মুড নাই।’ নিজের লম্বা শরীরের কথা ভেবে মনটা খারাপ হলেও হাল ছাড়ল না জিরাফ। কচ্ছপের পেছনে পেছনে ঘুরতে লাগল। কচ্ছপ তো খুব খুশি। জঙ্গলের সবাই তাকে পাত্তা দিচ্ছে। কিন্তু খুশিটা সে প্রকাশ করল না। মনে মনে ভাবল, মুখে গাম্ভীর্য না থাকলে সে আবার কিসের ফটোগ্রাফার! একসময় ছবি তোলার জন্য কচ্ছপের পেছনে কয়েকজনের লাইন পড়ে গেল। এই সুযোগে শিয়াল এসে বলল, ‘বস, আপনি এত বড় ফটোগ্রাফার, আপনার নিশ্চয়ই অ্যাসিস্ট্যান্ট লাগবে। আমি আছি বস। পাবলিকের ভিড় আমি সামলাইতাসি। আপনার টেনশনের দরকার নাই। আপনি খালি ক্লিক মারবেন।’
কচ্ছপের সম্মতি পেয়ে শিয়াল একটা কাগজে ছবি তুলতে আগ্রহীদের নাম লেখা শুরু করল। লেখার সময় প্রত্যেকের কানে কানে বলল, ‘হাতখরচের জন্য কিছু দিলে সিরিয়াল আগায় দিমু।’ এমন সময় গাছে ঝুলতে থাকা বানর বলল, ‘আচ্ছা, লাইন-টাইন না দিয়ে সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপ ছবি তুললেই তো হয়।’ বানরের কথা সবার পছন্দ হলো। সবাই বলল, ‘ঠিক। আমাদের কোনো গ্রুপ ছবি নাই। ফেসবুকে কভার ফটো হিসেবে দারুণ হবে।’ হাসিমুখে মাথা নাড়লেও শিয়াল মনে মনে বলল, ‘ব্যাটা বান্দরের বাচ্চা!’
সুন্দর একটা নদীর সামনে দাঁড়াল সবাই। জিরাফ সামনে থাকার জন্য অনেক চেষ্টা করলেও সবাই মিলে পেছনে পাঠাল তাকে। ছবি তোলার আগ মুহূর্তে মেকআপও করল অনেকে। জেব্রার সাজ দেখে বানর বলল, ‘তুই পাইকারি হারে পাউডার দিলি কেন? তোর কালো স্ট্রাইপগুলাও তো সাদা হয়ে গেছে। গাধার মতো লাগছে এখন।’
‘তোর বান্দরের মতো চেহারাটা আয়নায় দেখেছিস কখনো?’ মুখ বাঁকিয়ে বলল জেব্রা। হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে কচ্ছপ বলল, ‘সবাই চুপ। এখনই ছবি তোলা হবে। আমি কিন্তু একটার বেশি ছবি তুলব না।’
সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল সবার নড়াচড়া। শুধু কোনায় দাঁড়ানো হায়েনা ফিকফিক করে হাসছে। কচ্ছপ ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে, তারপর বসে এবং সবশেষে শুয়ে পড়ল ছবি তোলার জন্য। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে দেখছে কচ্ছপ। ওদিকে কড়া রোদেও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কচ্ছপ শুয়ে শুয়ে দেখছে তো দেখছেই। অধৈর্য হয়ে জলহস্তি বলল, ‘ছবি তুলতে এতক্ষণ লাগে? তুই কচ্ছপ না সেলিব্রিটি?’ কচ্ছপ রাগী কণ্ঠে বলল, ‘আমি অটো ফোকাসে ছবি তুলি না। ম্যানুয়ালে তুলি। শাটার স্পিড, অ্যাপারচার, ফোকাস—এসব ঠিক করতে হবে না?’
নদীর স্রোতের মতো সময়ও বয়ে যাচ্ছে। ছবি এখনো তোলা হয়নি। এরই মধ্যে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ঘোড়া। বিরক্ত হয়ে গাছে ফিরে গেছে বানর। কিন্তু কচ্ছপের সেদিকে খেয়ালই নেই। সে তখন অ্যাপারচার, শাটার স্পিড ঠিক করতে ব্যস্ত। কোনোভাবেই কিছু হচ্ছে না। শাটার স্পিড ঠিক হয় তো অ্যাপারচার ঠিক হয় না। অ্যাপারচার ঠিক হয় তো শাটার স্পিড ঠিক হয় না। অনেকক্ষণ পর তার মনে হলো, অটো ফোকাস তো ক্যামেরারই একটা অপশন। এটা ব্যবহার করা যেতেই পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। কচ্ছপ অটো ফোকাস মোড সিলেক্ট করেই চোখ বুজে তুলে ফেলল ছবি। কিন্তু স্ক্রিনে ছবিটা দেখতে গিয়ে সে তো অবাক। শুধু নদীর ছবি এসেছে! ঘটনা কী? এতক্ষণে কচ্ছপের খেয়াল হলো, অ্যাপারচার, শাটার স্পিড ঠিক করতে গিয়ে সে কাটিয়ে দিয়েছে দুই ঘণ্টা। আর তার এই ধীরগতির ফটোগ্রাফিতে ত্যক্ত হয়ে সবাই একে একে নিজ নিজ কাজে চলে গেছে। কিন্তু কচ্ছপ দমে যাওয়ার পাত্র নয়। সদ্য তোলা ছবির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে সে বলল, ‘বাহ্! কী অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ!’