একটি টি-শার্টের বিষাদ গল্প

.
.

আমি একটি টি-শার্ট। জন্ম ঢাকার একটি গার্মেন্টসে। বেড়ে উঠেছি শাহবাগের আজিজ মার্কেটে। এতটুকু পর্যন্ত আমার জীবন আনন্দের ছিল। একদিন আমি বিক্রি হয়ে গেলাম। ক্রেতার সঙ্গে বাসায় ফিরে জানতে পারলাম, তিনি একজন ব্যাচেলর। পরদিন আমাকে গায়ে জড়িয়ে বেশ মাঞ্জা মেরে তিনি গেলেন প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর প্রেমিকা নরম মনের মানুষ, টি-শার্টের কোয়ালিটি দেখতে কী আলতো করেই না ছুঁয়ে দিলেন আমাকে!
সারা দিনের পরিশ্রম শেষে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন ঘামে লেপ্টে গেছে আমার পুরো শরীর। আশা করছিলাম, কেউ আমাকে এক বালতি পানিতে ভিজিয়ে রাখবে। ভেবেছিলাম গা থেকে আমাকে খুলে হয়তো একটু বিশ্রাম দেওয়া হবে। কিন্তু কিসে কী? ক্লান্ত আমাকেই গায়ে জড়িয়ে তিনি লেগে গেলেন গেমস খেলতে। সে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেল, তবুও আমার বিশ্রাম হলো না। এমনকি ঘুমের সময়ও আমাকে গায়ে জড়িয়ে ঘুমালেন। তাঁর গায়ের গন্ধে আমার প্রায় বমি এসে যাচ্ছিল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে বিনা বিশ্রামে বাইরে নিয়ে গেলেন। সারা দিন ক্লাস করলেন, আড্ডা মারলেন, ডেটিং করলেন। কিন্তু আমার একটু গোসল করা হলো না! সব কাজ শেষে বাসায় ফিরেছেন ভদ্রলোক। এবার তো আমাকে গোসল করানো হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তো জুটে যেতে পারে একটুখানি খাঁটি লেবুর সুবাসযুক্ত ওয়াশিং পাউডার। কিন্তু আমার ধারণা ভুল, আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হলো হ্যাঙ্গারে। তাও একটু শান্তি, ফ্যানের বাতাসে নিজের ঘাম শুকিয়ে নিয়েছি সারা রাত। বিশ্বাস নেই, সকালে আবার আমাকে নিয়েই বেরিয়ে যেতে পারেন। হলোও ঠিক তাই। আবার সারা দিন এটা-সেটা শেষে সন্ধ্যায় ব্যাচেলর ভদ্রলোক গেলেন ডেটিংয়ে। ঘটনাটা ঘটল তখনই। তাঁরা দুজন কাছাকাছি। আমি তো লজ্জায় মরি। ভদ্রলোক ও আমি—দুজনের গা থেকে বেরোচ্ছিল বোটকা গন্ধ। এমন সময় ভদ্রলোকের প্রেমিকা বলে উঠলেন, ‘তুমি এই টি-শার্ট আজ কয় দিন পরতেছ? গা থেকে তো গন্ধ বের হচ্ছে। আজকেই এটা ধুয়ে দিবা!’ কী যে ভালো লাগল তখন! বাসায় ফিরে ভদ্রলোক আমাকে খুলেই ছুড়ে দিলেন রুমের ফ্লোরের এক কোনায়। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম, সঙ্গী কেউ ছিল না বলে শেয়ার করতে পারিনি। দুদিন এভাবে পড়ে থাকার পর আমাকে সঙ্গ দিতে এসে হাজির একটা প্যান্ট। আমরা দুজন দুই পৃথিবীর মানুষ হলেও দুজনের দুঃখ এক। একটুখানি গোসল করতে চাই, একটু ওয়াশিং পাউডারের ছোঁয়া চাই। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। এরপর ধীরে ধীরে আমার ওপরে জমা হয়ে গেল প্রচুর শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট, ফতুয়া ও আরও ছোট ছোট কিছু বস্ত্র। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অথচ আমার কিছুই করার ছিল না। বেঁচে থাকার সব আগ্রহই হারিয়ে ফেললাম একসময়। এভাবেই বোধ হয় দিন পনেরো কেটে গেল। একদিন সকাল সকাল দেখলাম, ভদ্রলোক আমার ওপরে জমে থাকা কাপড়গুলো বেশ ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছেন। মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আজ বোধ হয় আমরা গোসল করতে যাচ্ছি। ভাবতেই আনন্দ লাগছে—আমার গাজুড়ে ওয়াশিং পাউডারের ঘ্রাণ, পানি ঝেড়ে তারপর কোনো দড়ি ধরে রোদে ঝুলে থাকা। আজ দিনটা সত্যিই ভালো যাবে হয়তো। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ভদ্রলোক অনেক খুঁজে আমাকে হাতে নিলেন এবং দ্বিধাহীনভাবে আমাকে গায়ে জড়ালেন! খুব অবাক হলাম, আমাকে পরতে পরতে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে বলছিলেন, ‘দোস্ত, দেখ তো ওই ফতুয়াটা থেকে এই টি-শার্টটা পরিষ্কার মনে হচ্ছে না?’