বুয়াপুরাণ

.
.

বিকট চিত্কার শুনে আমি দৌড়ে রান্নাঘরে গেলাম। দেখি সুমন রান্নাঘরে এক হাতে ভাতের থালা আরেক হাতে লুঙ্গি ধরে হনুমানের মতো লাফাচ্ছে আর ‘ও খালুগো, মরে গেলাম গো!’ বলে মরণ চিত্কার দিচ্ছে। আমি হকচকিয়ে যাই। ততক্ষণে সবাই রান্নাঘরে চলে এসেছে। সুমনকে জাপটে ধরে মাথায় পানি ঢালাতে পরিস্থিতি সামান্য নিয়ন্ত্রণে এল। ওকে প্রশ্ন করি, ‘এভাবে চিত্কার করছিস কেন? তোর চিত্কার শুনে তো যেকোনো মুহূর্তে দমকল বাহিনী চলে আসতে পারে।’
সুমন ভীত চোখে থালাটা দেখিয়ে বলল, ‘তরকারিটা একটু খেয়ে দেখেন।’
আমি তরকারির দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলাম না। একটু বেশি লাল, হয়তো মরিচ বেশি দিয়েছে। আমাদের বুয়ার পূর্বপুরুষেরা বাংলার নবাব পরিবারের প্রতিবেশী ছিল বলে বুয়ার মধ্যেও পুরোপুরি নবাবি স্বভাব চলে এসেছে। উনি কোনো কিছুই অল্প রান্না করতে পারেন না। বাসায় এক বস্তা চাল থাকলে আমাদের পাঁচজনের জন্য একসঙ্গে পুরো বস্তা রান্না করে ফেলেন। তারপর আমরা কাঁদো কাঁদো স্বরে বুয়াকে বলি, ‘এত ভাত রেঁধেছেন কেন! আমরা তো এর এক আনাও খেয়ে শেষ করতে পারব না।’ তখন বুয়া আমাদের কড়া করে ঝাড়ি মেরে বলেন, ‘এই জন্যেই তো সবাই চিকনা-পাতলা। ভাত খাইবেন একেকজন এক গামলা কইরা। পুরা ডেকচির ভাত আইজকার মধ্যেই খায়া শেষ করবেন।’
বুয়ার কথা শুনে আমরা উদাস হয়ে যাই। একজন খানদানি বুয়ার সান্নিধ্য লাভ করতে পেরে আমাদের অদ্ভুত আনন্দ হতে থাকে।
আফজালের ‘ওরে ফুফাগো, তুমি কই গেলা গো!’ চিত্কার শুনে আমার সংবিৎ ফিরে আসে। দেখি আফজাল এক হাতে লুঙ্গি ধরে রীতিমতো লাফাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর বিকট চিত্কার দিচ্ছে। সুমনকে ঠান্ডা করার পর আবার আফজালের একই দশা! আমি হতভম্ব হয়ে অন্যদের দিকে তাকাতেই সবাই আমাকে তরকারিটা দেখিয়ে দিল। আফজাল আঙুল দিয়ে তরকারিটা একটুখানি মুখে দিয়েছে, তারপর এই অবস্থা। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। এই শাহিখানাই যত নষ্টের মূল!
পরদিন বুয়া এলে সুমন রেগেমেগে বুয়াকে বলল, ‘জঘন্য তরকারি রাঁধার কারণে আপনাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হলো। এই মুহূর্ত থেকে আপনার চাকরি নট।’
সুমনের কথাটা বুয়া পাত্তাই দিল না, ‘শোকজ করা ছাড়া ডাইরেক চাকরি নট কইরা দিবেন, এইডা কেমুন কথা!’
সুমন অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি গতকাল এক কেজি লবণ আর এক বয়াম গুঁড়া মরিচ দিয়ে তরকারিকে পুরা গ্রেনেড বানিয়ে ফেলেছিলেন। এই তরকারি খেলে আমরা সবাই মারা যেতাম।’
বুয়ার কোনো ভাবান্তর নাই, হেলেদুলে চলে যাওয়ার সময় বলল, ‘আমার চাকরি খাওয়া অত সোজা না! আপনেরে আমি এইখান থিকা স্ট্যান্ড রিলিজ কইরা নাইক্ষ্যংছড়ি পাঠামু। একটু পরেই ফিরা আসতেছি। তারপরে বুঝবেন ঠ্যালা!’
সুমন হকচকিয়ে গেল। আমরা আতঙ্কিত হয়ে বুয়ার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে বুয়া এলাকার একদল লোক নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। তারপর আমাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘এনারা বলে আমার চাকরি নট কইরা দিব! কত্ত সাহস! এরারে আমি এই এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলাম।’
মুরুিব্বগোছের একজন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহা, থামো তো রহিমার মা। ব্যাপারটা আমরা দেখতেছি।’ তারপর তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তদন্ত ছাড়া আপনেরা বুয়ার চাকরি নট করতে পারবেন না। আমি তিন সদস্যবিশিষ্ট একটা তদন্ত কমিটি গঠন কইরা দিতেছি। অত্র এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, একজন যুবনেতা আর একজন ছাত্রনেতা এই কমিটির সদস্য। উনারা বুয়ার রান্না খাইয়া রিপোর্ট দেওয়ার পর আমরা এটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিব।’
ছাত্রনেতা গমগমে গলায় বক্তৃতা দিয়ে উঠল, ‘যুগে যুগে এভাবে নিষ্পেষিতদের অত্যাচার করে গেছে জালিমরা। এই বুর্জোয়া, পুঁজিবাদের দিন শেষ। বুয়ার অধিকার রক্ষার এই লড়াই চলবে আমাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত।’ আমরা সবাই ভ্যাবদা মেরে গেলাম।
পরদিন তদন্ত কমিটির তিন সদস্য আমাদের বাসায় আস্তানা গাড়লেন। বুয়া রান্না করার মধ্যবর্তী সময়টায় আয়েশি ভঙ্গিতে তাস খেলে কাটালেন তাঁরা। আমরা কিছুক্ষণ পরপর রান্নাঘরে উঁকি দিই, দেখি বুয়া আপনমনে রান্না করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে, ‘সাধের লাউ বানাইলে মোরে...।’
কিছুক্ষণ পর রান্না হয়ে গেলে বুয়া তদন্ত কমিটির সদস্যদের বলল, ‘আপনেরা খাইতে আসেন। এমুন রান্না করছি, আগামী এক সপ্তাহ এই খানার সুবাস পাইবেন।’
তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান থালা থেকে এক চিমটি তরকারি নিয়ে জিহ্বায় ছোঁয়ালেন, তারপর কথাবার্তা ছাড়াই দরজা খুলে দৌড় মারলেন। বাকি দুই সদস্য হকচকিয়ে গেল। আমরা তাঁদের উত্সাহ দিয়ে বললাম, ‘ব্যাপার না, আপনারা খেয়ে দেখেন।’
ছাত্রনেতা এবং যুবনেতা তরকারি একটু জিবে ছোঁয়াতে তাঁরাও কথাবার্তা ছাড়া দৌড় মারলেন। বুয়া পুরো ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে উদাস হয়ে আমাদের বললেন, ‘মনে হয় উনারা বর্ডার পার হইয়া বার্মার দিকে চইলা গেছে। আর কিছু করার নাই। উনারা ফেরত আইসা তদন্ত শেষ না করা পর্যন্ত আমারেই রান্না করতে হইব। আপাতত আইজকা যা রান্না করছি সেগুলা খান। কালকে আরও ভালো কইরা রান্না করব।’
বুয়ার কথা শুনে আমরা সবাই একযোগে উদাস হয়ে গেলাম।