অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভ হতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

প্রথম আলোর আয়োজনে ‘অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও বাজেট প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২১ মে ২০২২। এ গোলটেবিল আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

আলমগীর কবির

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সাবেক চেয়ারম্যান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বিশেষ ফেলো, সিপিডি

নাজনীন আহমেদ

কান্ট্রি ইকোনমিস্ট, ইউএনডিপি

মাশরুর রিয়াজ

চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ

এম এ রাজ্জাক

চেয়ারম্যান, র‌্যাপিড

সায়েমা হক

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তাহরিন তাহরিমা চৌধুরী

গবেষণা সহযোগী, বিআইডিএস

সঞ্চালনা

শওকত হোসেন

হেড অব অনলাইন, প্রথম আলো

সুপারিশ

■ গরিব মানুষের খাদ্যসহায়তায় ভর্তুকি বাড়াতে হবে। তাদের জন্য প্রত্যক্ষ নগদ ও খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।

■ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারনির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

■ মূল্যস্ফীতিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখতে হবে

■ রাজস্ব, আর্থিক খাত ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় সংস্কার করতে হবে।

■ বিলাসপণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত বা নিষিদ্ধ করতে হবে।

■ প্রশাসননির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

■ বিদেশ থেকে কম সুদে বা নমনীয় ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ দরকার।

■ ব্যবসার কাঠামো ও অবকাঠামোগত পরিবেশের উন্নতির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।

আলোচনা

শওকত হোসেন

প্রথমেই আপনাদের সবাইকে প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত আজকের এ আলোচনায় স্বাগত জানাই। আমরা যখন এ বৈঠক আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিলাম, তখন আমাদের ভাবনায় ছিল শুধু আগামীর বাজেট। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। অর্থনীতিতে আমরা একধরনের চাপ বা সংকট দেখতে পাচ্ছি। তাই আমাদের আজকের আলোচনায় বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনারা যেমন কথা বলবেন, তেমনি বাজেট সামনে রেখে নতুন পথনির্দেশনাও তুলে ধরবেন আপনারা—এ প্রত্যাশা করছি।

আলমগীর কবির

আলমগীর কবির

অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার সুযোগ আগে আমাদের কম হয়েছে। আগেও অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছে। তবে এবার মন্দা শুরুর আগেই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বলতে ইচ্ছে করছে, কেন এই আতঙ্ক তৈরি হলো?

বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, সেটা আমার জানা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই জানে, তার ডিলার ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকার ওপরে। এত পার্থক্য কেন? তাহলে কি এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? যদি নিয়ন্ত্রণ থাকত, তাহলে এ অবস্থা হবে কেন?

অর্থনীতি নিয়ে নীতিটা কার হাতে, সেটি আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা কালকে যে পণ্য আমদানি করব, তার জন্য ডলারের কী দর হবে, সেটি ঠিক করতে পারছি না। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও ঊর্ধ্বমূল্যায়ন দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত হলে আমরা সেটি মোকাবিলা করতে পারি। তার চেয়ে বেশি পরিবর্তনের জন্য আমরা প্রস্তুত নয়। এটা ব্যবসাবান্ধব হওয়া দরকার। এটা হচ্ছে না।

আমরা পণ্য আমদানিতে ইউপাস এলসি (ঋণপত্র) করি। এই ঋণপত্রের অর্থ বিদেশি মুদ্রায় ব্যাংকগুলোকে পরিশোধের জন্য আমরা তিন-চার মাস সময় পাই। আমরা ধরেই নিই, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণপত্রের অর্থ যখন পরিশোধ করব, তখন সামান্য কিছু পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এখন কী দেখা যাচ্ছে। প্রতি ডলার ৮৫ বা ৮৬ টাকা ধরে আমরা পণ্য বাজারে বিক্রি করেছি। কিন্তু বর্তমানে প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দরে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এটা খুবই অপ্রত্যাশিত। এ দায় কে নেবে?

আমরা ব্যবসায়ীরা প্রথমত তিনটি কাজ করি। প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের বেতন, সরকারের রাজস্ব নিশ্চিত করা ও ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে থাকি। এই তিন কাজ করার পর আমাদের মুনাফা থাকতেও পারে, না–ও থাকতে পারে। তারপরও আমাদের ওপরই কেন এত খড়্গ। আমাদের নিয়ে রাজস্ব বিভাগে সভা করা হয়। আমরা বাস্তব চিত্র তুলে ধরি। কিন্তু নীতি তাদের মতো করেই হয়।

জ্বালানি তেল, পেট্রল ধনীরাই বেশি ব্যবহার করেন। পেট্রলের জন্য সরকার অনেক টাকা ভর্তুকি দেয়। একইভাবে গরিব মানুষের খাদ্যের জন্য এবং যেখানে তাদের জন্য পণ্য উৎপাদিত হয়, সেখানে আমরা কর ভর্তুকি দিতে পারি। সেগুলো তো আমরা দেখি না। ঢালাওভাবে সবকিছু করা হয়। আমাদের দেশে তো ভালো ওয়েলফেয়ার নেই। ওয়েলফেয়ার দেব না, আবার করকাঠামোও গরিববান্ধব করব না—এটা হতে পারে না। এখানে বড় কিছু করার দরকার।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান

পুরো আর্থিক খাতের ৯০ শতাংশ অর্থায়ন গেছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। কারণ, দেশে অন্য কোনো মাধ্যম থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। এ জন্য করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার ৯০ শতাংশ ব্যাংকগুলো দিয়েছে। ঋণ দিতে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃ অর্থায়ন পেয়েছি, সরকার সুদ ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু দিন শেষে ঝুঁকি বেড়েছে ব্যাংকগুলোর। কম সুদে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার ৩০-৪০ শতাংশ এখন ফেরত আসছে না। এসব ঋণের মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মে আছে, এসব ঋণের মেয়াদ এক বছরের বেশি হবে না। এ জন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মেয়াদ বাড়ানোর বিশেষ অনুমোদনের জন্য যাচ্ছি। বড় অনেকে এই ঋণ ফেরত দেবেন। কিন্তু যারা ছোট ও মাঝারি, তাদের থেকে ঋণ ফেরত পাওয়া কঠিন। প্রথম ধাপে ছোট ও মাঝারিদের ঋণ দেওয়া হয়েছে। এখন দ্বিতীয় ধাপে দেওয়া হচ্ছে। ছোট ও মাঝারিরা কিস্তি একবার দিতে ব্যর্থ হলে আর আদায় সম্ভব হয় না। কারণ, ছোট ও মাঝারিদের আয়ের উৎস একটাই।

এরপরও নানা অভিযোগ আসে, ব্যাংকগুলো ছোট গ্রাহকদের ঋণ দেয় না। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে ছোটদের ট্রেড লাইসেন্সও থাকে না। এ জন্য ঋণ দিতে সময় লাগে। কিন্তু ঋণ দেয় না, এটা ঠিক না। সাম্প্রতিক সময়ে ডলার নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। গত বছরের এই সময়ে ডলারে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। কারণ, গত বছরে আমদানি কম হয়েছিল। সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। আর যোগাযোগ বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা সব অর্থ বৈধ চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন। অনেক প্রবাসী তঁাদের জমানো সব অর্থ নিয়ে দেশে এসেছিলেন। তখন প্রবাসী আয়ের কারণে রিজার্ভ বেড়েছিল। এ জন্য সবাই উল্লসিত ছিলাম। ওই সময়ে ব্যাংকগুলো থেকে ৮০০ কোটি ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তার সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছিল। এখন সময় পুরো উল্টো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। যার সমপরিমাণ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। ফলে ডলারের সঙ্গে টাকারও সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় পড়ে যাব, আগে এমনটা ধারণাও করিনি।

প্রবাসী আয় আনা কোনো লাভজনক ব্যবসা না। একমাত্র এই ব্যবসা থেকে ব্যাংকের কোনো আয় আসে না। রোজার কারণে প্রচুর আমদানি হয়েছে। আমদানি ঝুড়িতে নতুন নতুন পণ্য যুক্ত হয়েছে। অনেকের খরচের ধরন পাল্টে গেছে। ফলে আমদানি বেড়ে গেছে। তবে প্রবাসী আয় কমে গেছে। এতেই সংকট তৈরি হয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম বাড়াচ্ছে না। তবে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম যা–ই হোক না কেন, ডলারের দাম তো বেড়েই গেছে। বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

আসন্ন বাজেট নিয়ে এত কম আলোচনা গত ৩০ বছরে দেখিনি। আমি মনে করি, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। ১. পরিস্থিতির বিশ্লেষণ, ২. ব্যবস্থাপত্র কী ৩. এই ব্যবস্থাপত্র বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াগত কী বিষয় আছে।

প্রথমেই আসি পরিস্থিতির বিশ্লেষণে। যদি বলেন, পরিস্থিতি বোঝা যায়নি, তাহলে এটা আমি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি। কারণ, গত এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে এখানে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা অর্থনীতিতে বিভিন্ন কাঠামোগত অসংগতির কথা বলছেন, সংস্কারের অভাবে এগুলো অর্থনীতিতে কত ধরনের বাধা সৃষ্টি করছে, তা বলে আসছেন। তাই এসব বিষয় নিয়ে একধরনের অস্বীকৃতির মনোভাব আছে। তথ্যের প্রতি অবজ্ঞা, অনেক ক্ষেত্রে তথ্যের প্রতি অন্ধত্ব আমাদের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমরা যে উন্নয়ন উপাখ্যান তৈরি করেছি, এটি যদি যুক্তিসংগত না হয়, তাহলে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণকেও অপমানসূচক বক্তব্য দিয়ে ছোট করার চেষ্টা করছি।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকার ক্রমান্বয়ে মেনে নিচ্ছে, অর্থনীতিতে সংকটময় পরিস্থিতি বিকাশমান। আমরা বলি বিরাজমান। বিকাশমান ও বিরাজমান—দুটিই সত্য। একধরনের ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে যে আয়-ব্যয় পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চলতি খাতে ক্রমবর্ধমান ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন ও অপর্যাপ্ত পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটিতে আলোচনা করার কথা বলছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে, যা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে। দেরিতে হলেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, এ পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর উপায় কী, ব্যবস্থাপত্র কী? এখন সময় হলো মধ্য মেয়াদের চেয়ে স্বল্প মেয়াদে বেশি মনোযোগ দেওয়া। দু-তিন বছরের একটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। পাশাপাশি ব্যাংক-বিমাসহ আর্থিক খাত, পুঁজিবাজার, রাজস্ব খাত, স্থানীয় সরকার—এসব বিষয়েও মনোযোগ রাখতে হবে।

প্রবৃদ্ধিকে আমরা এখন অনন্য দেবতার স্থানে নিয়ে গেছি। প্রবৃদ্ধিকে সেখান থেকে নামাতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্য হতে হবে নিম্নবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে সুরক্ষা দেওয়া। ব্যয় ও আয়—দুই ক্ষেত্রেই তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।

মূল্যস্ফীতিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখতে হবে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন অনেক বেশি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা একধরনের ‘ছদ্ম অর্থনীতি’র মতো। যেমন দুই মাসের রেমিট্যান্স আয় দিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা, আমদানি খরচ বৃদ্ধির ফলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা চিন্তা করলে বাজেট ঘাটতি বড় বিষয় নয়। এই শ্রেণির মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ অর্থসহায়তা ও খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা রাখা দরকার। তাদের সুরক্ষা প্রতিষেধক হলো টিসিবির কার্যক্রম বিস্তৃত করা, খাদ্যমূল্য কমানো, এক কোটি পরিবারকে সহায়তা দেওয়া।

দ্বৈত বিনিময় হার অর্থনীতির জন্য সুবিধাজনক হয় না। সুদের হার ধরেবেঁধে রাখা উচিত নয়। আরেকটু নমনীয় বা মুক্ত করা উচিত। আবার ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ বিঘ্নিত না করে সরকারি ঋণ নেওয়ার সুযোগ করতে হবে।

এত দিন যে সংস্কার হয়নি, আমরা এখন তার ফল পাচ্ছি। বর্তমানে আমরা একটা প্রশাসননির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছি। এই সংকটের মধ্যে মুদ্রা সমন্বয়–সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক হয়েছে কি না, জানি না। তিন মাস অন্তর সংসদে আর্থিক বিবৃতি দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় না। গত তিন বছরে অর্থ মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তিন-চারটি সভা হয়েছে। অর্থ ও মুদ্রানীতি–সম্পর্কিত এই সরকারের করা আইন আছে। সেখানে যেসব কাজ করার কথা বলা আছে, সেগুলোও সরকার করে না। এর ফলে যেটা হচ্ছে, সব নীতিব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হলে পদক্ষেপগুলো প্রতিক্রিয়ার মতো আসে। সমস্যার আগে উদ্যোগ নেওয়া হয় না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন একটি অটো পাইলটের ভেতরে আছে। অদৃশ্য পাইলটের মাধ্যমে এটি চলে। এটা তো হতে পারে না।

বর্তমান সংকটকে সুযোগ হিসেবে দেখে সংস্কার করতে হবে। কোভিডের সময় টিকা দেওয়ার জন্য অ্যাপস ব্যবহার করা হয়েছে। এটা সফল হলো। আমরা যে পারি না, তা নয়। তাই রাজস্ব খাত, আর্থিক খাত ও স্থানীয় সরকারের মতো জমে থাকা সংস্কারগুলো করতে হবে। কিন্তু আমরা সেই ধরনের উদ্যোগ দেখছি না।

নাজনীন আহমেদ

নাজনীন আহমেদ

মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণকেই আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূলনীতি হিসেবে দেখা উচিত। মূল্যস্ফীতি ও বিদেশি মুদ্রার মজুত—এ বিষয় আমাদের ভোগাচ্ছে। আজকের যে পরিস্থিতি, ২০২১ সালে বা গত বাজেটের আগে থেকেই এ ধরনের আশঙ্কার কথা কি বলিনি? আমরা বলেছি। ২০২০ সালের প্রবাসী আয় বেড়েছিল। আমরা আশঙ্কা করেছিলাম যে প্রবাসী আয় কমবে, প্রবৃদ্ধিও কমবে। এ ছাড়া আমদানিও বাড়বে, সে কথাও বলা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক অবস্থা ছিল না। এই প্রবৃদ্ধি থাকবে না। করোনার পর বহু মানুষ দুবাই ও থাইল্যান্ড গেছেন। বিদেশে ঘুরতে যাওয়া বেড়েছে। এই প্রবণতা শুধু আমাদের দেশে নয়, দুনিয়াজুড়েই হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছিল। এই সমস্যা শুধু আমাদের একার নয়; ইউরোপ-আমেরিকার বাজারেও একই অবস্থা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাড়তি পরিবহন খরচ। অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও ঋণের প্রবাহ বেড়েছে। সব একসঙ্গে হওয়ায় আমরা এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি।

ডলারের দাম সমন্বয় করে কালকেই যদি আমরা ৯৫-৯৬ টাকায় চলে যাই, তাহলে অবশ্যই মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে। এই মূল্যস্ফীতি শুধু গরিব মানুষের নিত্যপণ্যে নয়; শিল্প খাতের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির খরচ বাড়াবে। এতে যদি উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, তাহলে কী হবে? আমরা বলছি, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিষয়ে উদ্যোগ দেখছি না। অন্যদিকে ডলারের দাম ‘ধপ’ করে বাড়িয়ে দিয়ে খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছি। এতে উৎপাদন ব্যাহত করছি। আবার মূল্যস্ফীতিও থাকছে। তাই আমি ডলারের দাম ধাপে ধাপে সমন্বয় করার বিষয়টি সমর্থন করি।

এখন যে অর্থনীতিতে অস্থিরতা চলছে, তা লম্বা সময়ের জন্য নয়। নিশ্চিত করে আমরা বলতে পারব না, এটা চলতে থাকবে। ইতিমধ্যে আমরা দেখছি, রোজার সময়ে আমদানি অনেক বেড়েছিল। এখন তা কমেছে। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে আমদানি খরচ বাড়বে। আবার রেমিট্যান্সও প্রবাহ বাড়বে, এটা ধরেই নিতে পারি।

বিদেশি মুদ্রার মজুত নিয়ে চিন্তিত। হঠাৎ করে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। যখন ৩২ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলো, তখন কি আমরা বলিনি যে এটা সাময়িক। রিজার্ভ কমবে। আমরা জমাই কেন? দুর্দিনে খরচ করার জন্য। এখন রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ ছাড়ছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক সিদ্ধান্ত। আরও কিছু ছাড়া উচিত। চলতি হিসাবে ঘাটতি হচ্ছে। ৪-৫ বিলিয়ন ডলারের পার্থক্য হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট বা মূলধনি হিসাব তো আছে। তবে ব্যাংক রেট ও খোলাবাজারের রেটের মধ্যে ব্যবধান কমাতে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কয়েক দিন আগে ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা আরও আগে করা উচিত ছিল। তাঁরা (ডিলার) যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি মানেন, সে ব্যাপারে আরও কঠোর হতে হবে। আমরা একটা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি। তাই যে সঞ্চয় রাখছি, তা ব্যবহার করব। দ্বৈত মুদ্রানীতি স্বল্পকালীন করা ঠিক আছে। কিন্তু যেন বিদ্যুৎ খাতের মতো না হয়ে যায়।

মাশরুর রিয়াজ

মাশরুর রিয়াজ

বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। এটা কিন্তু অনুমিতই ছিল যে ২০২২ সালে করোনার প্রভাব কমলে বৈশ্বিকভাবে পুঞ্জীভূত চাহিদা বাড়বে। তার প্রভাব পড়বে ভোগ্যপণ্য, সরবরাহ, শ্রমবাজারসহ সব জায়গায়। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে এ পরিস্থিতি আগে থেকে মোকাবিলা করতে পারিনি। করোনার সময়ে ইউপাস-এলসির লেনদেন নিষ্পত্তির সময় ১২০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩৬০ দিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ঢালাওভাবে ফেরত আনা হয়েছিল গত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। এতে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেল। কিন্তু আমরা যদি এটা বুঝতাম, যেটা বোঝা উচিত ছিল, তাহলে এটা পণ্যভেদে (ইউপাস-এলসি নিষ্পত্তি) ধীরে ধীরে করতাম। এ রকম করে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে বিনিয়োগ পরিবেশ নষ্ট হয়।

বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সক্ষমতা, ব্যবসায়ের খরচ ও অদক্ষতার দিক দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। অদক্ষতার কারণে এমনিতেই আমাদের দেশে ব্যবসার খরচ (কস্ট অব ডুইং বিজনেস) অনেক বেশি। করহার, বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট খরচ, অবকাঠামো, ইনফরমাল পেমেন্টস ইত্যাদি অনেক বেশি। এর সঙ্গে এখন সরাসরি যুক্ত হচ্ছে কাঁচামাল, জ্বালানি ও শ্রমের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়। কারণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। শ্রমের মজুরিও বাড়াতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বিনিয়োগ সক্ষমতায় তেমন এগোতে পারছি না। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও খরচ, সময় ও জটিলতা অনেক বেশি। সব মিলিয়ে বর্তমান অবস্থায় বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের দিক দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছাকাছি স্বল্প সময়ে আমরা যেতে পারব না।

আমাদের অর্থনৈতিক নীতি গঠনে নেতৃত্বের অভাব আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে সমন্বয় করে কাজ করা হয় না। এখানে এক হাত জানে না অন্য হাত কী করছে। এ কারণে সংকট তৈরি হলে সময়োপযোগী উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয় না। যেমনটা আমরা বর্তমান পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নেতৃত্বহীনতার পাশাপাশি দেশের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কুক্ষিগত (রেগুলেটরি ক্যাপচার) হয়ে আছে। নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যে কুক্ষিগত হয়ে আছে, সেটা কেউ দেখছে না। একটা পুরো খাতের নীতি বদল হয়ে যায়, একটা বা দুটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার জন্য।

এত দিনেও রাজস্ব খাতের সার্বিক সংস্কার হয়নি। কাস্টমস খাতে গত ২০ বছরে ছোটখাটো কিছু ডিজিটালাইজেশন হয়েছে, আয়কর খাতেও ই-টিআইএন ছাড়া উল্লেখ করার মতো কিছুই হয়নি। ভ্যাট খাতে অটোমেশন ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। রাজস্ব নীতিতেই গন্ডগোল আছে। কাস্টমসের একটা নতুন আইন ২০১৫ সাল থেকে কাজ করে ২০১৯ সালে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন পেয়ে জাতীয় সংসদে গিয়ে পাস না হয়েই ফিরে এসেছে। এটা হয়েছে প্রশাসননির্ভর নীতির কারণে। প্রশাসন আর কাস্টমস ক্যাডারের দ্বন্দ্বে এটা হয়নি। এসব সমস্যা সমাধানে প্রশাসন থেকে করনীতিকে আলাদা করতে হবে।

এম এ রাজ্জাক

এম এ রাজ্জাক

অনেক দিন ধরে আমরা বলে আসছি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে সমন্বয় করতে হবে। আমাদের সঙ্গে ভিয়েতনামসহ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের মূল্যস্ফীতির কী পার্থক্য রয়েছে, তা সমন্বয়ের কথাও বলা হয়েছে। তবে গত ১০ বছরে কিছুই করা হয়নি। তাতে যেটি হয়েছে, আমরা টাকায় বড়লোক হচ্ছি। তবে ডলারে রূপান্তর করলেই আমাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ডলারকে একটি জায়গায় ধরে রাখার কারণে পণ্য রপ্তানি খাতটি ছোটই রয়ে গেছে। আমরা রপ্তানিতে ৩০-৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে বড় আকারে প্রচার করছি। অথচ ভারতে রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যান্য প্রতিযোগী দেশেও রপ্তানি বাড়ছে। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এখনো ছোটই আছে।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেঁধে দেওয়ার কারণে মাথাপিছু আয়ে উল্লম্ফন হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। কারণ, ব্যাংকঋণের সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয়েছে। খোলাবাজারে বর্তমানে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৭-১০০ টাকায়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দর ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা। আমরা যদি ডলারের দর ১০০ টাকায় নিয়ে যাই, তাহলে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৩০০ ডলারে নেমে যাবে। এখানেই হচ্ছে আমাদের চ্যালেঞ্জ। এটি কি আমরা নিতে পারব?

অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ থাকেই বলেই অর্থনীতিবিদেরা নীতিতে নমনীয়তা আনার কথা বলেন। বাংলাদেশে আমরা নীতিনমনীয়তা নষ্ট করে ফেলেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কী করতে পারি। খোলাবাজারের ডলারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। সংকটের সময় এটি সবচেয়ে বেশি হয়। তাই এখন আমাদের ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের দিকে যেতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নমনীয় ঋণ পেতে দর–কষাকষি করা যেতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মূল্যস্ফীতির ভালো তথ্য–উপাত্ত নেই। সে জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা যাবে, সেটি বুঝতে পারা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। এই জায়গায় সরকারকে একটা সাধুবাদ দিতেই হয়। খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের আওতায় ৬২ লাখ মানুষকে পাঁচ মাস ৩০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদি আরও ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো যায়, তাহলে ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা নিশ্চিত করা যাবে। এই ৯ হাজার কোটি টাকা কিন্তু মোট বাজেটের মাত্র দশমিক ৮ শতাংশ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সহজেই এটি করা সম্ভব।

এ ছাড়া রপ্তানি খাতের দিকে তাকানোর সুযোগ আছে। কারণ, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমাদের আরও বাধা আসবে। ২০২৬ সালের নভেম্বরের পর রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। সে জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।

সায়েমা হক

সায়েমা হক

এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় মানুষকে স্বস্তি দিতে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কিন্তু সে জন্য প্রত্যক্ষ করের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। ডিজিটালাইজেশন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে এটা হতে পারে। অর্থাৎ পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ নীতি সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে আমাদের বেলায় বিষয়টি অনেক জটিল। তা সত্ত্বেও নীতি সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে মূল্যস্ফীতির হাত থেকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। সে জন্য আমদানিনীতির বিষয়ে সজাগ হওয়া প্রয়োজন, কোন পণ্য আমদানি জরুরি, কোনটা জরুরি নয়—এ বিষয়ে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। এ ছাড়া ওভার বা আন্ডার–ইনভয়েসিং হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি।

বাজেট নিয়ে আলোচনায় প্রবৃদ্ধি, প্রবাসী আয়—এসব বেশি গুরুত্ব পায়। কিন্তু আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। সাধারণ মানুষ প্রবৃদ্ধির সুফল কতটা পাচ্ছে, তা ভুলে যাচ্ছি। দেশের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কর্মসূচিগুলো মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। শহরাঞ্চলের জন্য বড়জোর পাঁচটি প্রকল্প আছে। শহরের জন্য বিশেষ কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে মাথাপিছু সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। হয়তো মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়ানো যাবে না, তা সত্ত্বেও বরাদ্দ কিছুটা হলেও বাড়ানো দরকার। এক কোটি মানুষকে কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা করার সরকারি যে প্রচেষ্টা, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু এসব তালিকা প্রণয়নে অনেক ধরনের ভ্রান্তি হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করতে হবে। কোভিডের শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি, তথ্যভান্ডার নেই। এই তথ্যভান্ডারের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়নি।

বাজেটে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের কর ছাড় দেওয়া হয়, কিন্তু শ্রমবাজারে এই ছাড়ের কী প্রভাব পড়ছে, তা নিরূপণ করা হচ্ছে না। ছাড়ের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারিত হলে ভালো। আমরা জানি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ মানুষের কর্মসংস্থানে কাজে আসে। সে কারণে তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কাগজপত্রের বেড়াজালের কারণে দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগসহ নানা বিষয় নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যবসার কাঠামো ও অবকাঠামোগত পরিবেশের উন্নতি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

তাহরিন তাহরিমা চৌধুরী

তাহরিন তাহরিমা চৌধুরী

আমাদের শিক্ষা খাত অনেকটাই অবহেলিত। করোনার মধ্যে বিদ্যালয় যত দিন বন্ধ ছিল, তত দিন এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে—অনলাইন শিক্ষার অনেক সীমাবদ্ধতা, সবাই এতে অংশ নিতে পারছে না ইত্যাদি। কিন্তু বিদ্যালয় খুলে যাওয়ার পর এ নিয়ে আলোচনা নেই। তার একটি কারণ হলো, এখন যারা বিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা এখনো জিডিপিতে ভূমিকা রাখছে না। তারা ভূমিকা রাখবে ভবিষ্যতে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, মহামারির সময় বিশ্বব্যাপী যে শিক্ষণ ক্ষতি হয়েছে, তার ভবিষ্যৎ আর্থিক মূল্যমান ১৭ ট্রিলিয়ন বা ১৭ লাখ কোটি মার্কিন ডলার—বৈশ্বিক জিডিপির ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া তারা লার্নিং পভার্টি বা শিক্ষণদারিদ্র্য নামে একটি সূচক ব্যবহার করে। সেটা হলো, ১০ বছর বয়সী শিশুরা মাতৃভাষায় গল্প পড়ে বুঝতে পারে। ২০১৯ সালে উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এর গড় মান ছিল ৫৩ শতাংশ, বাংলাদেশের জন্য ছিল ৫৬ শতাংশ। মহামারির অভিঘাতে কী হয়েছে, তা আমরা এখনো জানি না। তবে আমাদের যত শিশু ঝরে পড়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, এ পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছে।

এখন দুটি পরিস্থিতি বিবেচনা করা যাক: এক. মহামারির নতুন ঢেউ আর আসবে না, দুই. আবার নতুন ঢেউ আসবে এবং আমাদের আবার অনলাইন শিক্ষণে ফিরে যেতে হবে। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি, আমাদের শিক্ষণ ক্ষতি পরিমাণ নির্ধারিত। তবে এখনই আমরা তা বুঝতে পারব না, এখনকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন মাধ্যমিকে উঠবে এবং মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা যখন উচ্চমাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করবে, তখন এই ক্ষতি বোঝা যাবে। ২০২০ সালে যারা প্রথম শ্রেণিতে পড়ত, তারা এখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, কিন্তু বাস্তবতার সাপেক্ষে বলা যায়, এই দুই শ্রেণিতে তাদের যা শেখার কথা ছিল, সেটা তারা শেখেনি। ঘাটতি থেকে গেছে। এ ক্ষেত্রে গাম্বিয়ার দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। তারা শিক্ষার্থীদের ভাষা ও গণিতের মূল্যায়ন করে দেখার চেষ্টা করেছে, ঘাটতি কোথায়। এরপর স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করেছে।

আবার অনলাইন ক্লাসে ফেরত যেতে হলে আরেক হিসাব। আমরা হিসাব করে দেখেছি, অনলাইন ক্লাস করার জন্য মাসে ৩১২ টাকা ব্যয় হয়। এই টাকা শিক্ষার্থীদের আগেভাগে দেওয়া হলে তারা এই অর্থ অন্য কাজে ব্যয় করে ফেলতে পারে। সে জন্য বলা হয়েছিল, যারা এই অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে, মাস শেষে তাদের এই টাকা দিয়ে দেওয়া। বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশে এই নীতি চালু আছে। ফলে এখনো যদি আমরা ভাবি, শিক্ষা খাতে আগের মতো বরাদ্দ দেওয়া হবে, তাহলে ভুল হবে।

শওকত হোসেন

প্রথম আলোর ডাকে আপনারা আমাদের এখানে এসেছেন, মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন। সে জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের আলোচনা থেকে আমরা বেশ কিছু বিষয় জানতে পারলাম, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি আপনাদের সুপারিশগুলো আমরা প্রথম আলোতে তুলে ধরব। আবারও আপনাদের ধন্যবাদ।